পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ২৫৩ কোটি ডলার

বাড়ছেই বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫৩ কোটি বা ১২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানিতে জোয়ার বইতে শুরু করেছে। আর এতে আমদানি-রফতানির মধ্যে ব্যবধানও বাড়ছে।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য আবার সচল হচ্ছে। ফলে আমদানিতে জোয়ার বইছে। এতে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। একই সময়ে রফতানি আয় বাড়লেও আমদানির তুলনায় তা অনেক কম হারে বাড়ছে। এসময় রেমিট্যান্স প্রবাহও নিম্নমুখী। আমদানি-রফতানির ব্যবধানের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তেই থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ডলারের বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ঘাটতির এ পরিমাণ প্রায় এক লাখ সাত হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০৪ কোটি ডলার।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এতে এখনই দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কেননা তুলনামূলক কম হলেও একই সময়ে রফতানি আয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের মূল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাকালীন সময়ে পণ্য রফতানি কমলেও বর্তমানে এসব দেশে পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ফলে করোনার ধকল কাটিয়ে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা আবার উৎপাদন শুরু করেছেন। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি অনেক বেশি পরিমাণে বেড়েছে। তবে করোনার মধ্যে বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স বাড়লেও বর্তমানে তা অনেক কমে গেছে। যা বাণিজ্য ঘাটতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বাণিজ্য ঘাটতি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি হওয়ার কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্ব বাজারে পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে। আমদানি ব্যয় করোনার শুরুতে কমলেও এখন তা আবার বেড়ে গেছে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। তবে এতে দুশ্চিন্তার এখনই কোন কারণ নেই। কেননা আমদানির পাশাপাশি রফতানি আয়ও বাড়ছে। যদিও এসময় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এ বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে এক হাজার ৮৬৩ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে তিন হাজার ১১৬ কোটি ডলার। এ সময়ে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ তার আগের বছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি আয় করেছে। বিপরীতে পণ্য আমদানির ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৫৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ২ হাজার ২৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৮৬০ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। কিন্তু, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এই সূচকে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১০০ কোটি ডলার। মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬১৮ কোটি ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৩৫৫ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। নিয়মিত আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বও সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০২ কোটি ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে ৫০৬ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

আর্থিক হিসাবে এখনও উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ কোটি ৯০ লাখ (৪.৫৮ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের এই সময়ে ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতাদেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাক্সিক্ষত ঋণ সহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে এই উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৩০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫১ শতাংশ বেশি।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.