আবার দুই অঙ্কের ঘরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি

করোনার ধকল কাটিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফিরছে। প্রধান সূচকগুলোও বাড়তে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় এবং রফতানি আয় দুটোই বাড়ছে। সেইসঙ্গে দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহও বাড়ছে। যা দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত দুই বছর পর আবার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি অক্টোবরের চেয়ে দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১০ দশমিক ১১ শতাংশে উঠেছে। এর অর্থ হলো, গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে এই নভেম্বরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছেন। আগের মাস অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এখনও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে রয়ে গেছে এই সূচকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনও ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ পয়েন্ট কম ঋণ নিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলেন, করোনার ধকল কাটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংকিং খাতেও চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। ঋণের চাহিদা বাড়ছে। সে কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।

তাদের মতে, মহামারির সময় সরকারের প্রণোদনার ঋণ ছাড়া ব্যাংকগুলো অন্য কোনো ঋণ বিতরণ করেনি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমদানি-রফতানি বাড়ছে, অর্থনীতিতে গতি ফিরে এসেছে। উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগ করছেন। সে কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যায়, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মহামারির ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। এরপর সরকারের প্রণোদনা ঋণে ভর করে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ হয়। আগস্টে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে এবং সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। কিন্তু অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। নভেম্বরে তা আরও কমে ৮ দশমিক ২১ শতাংশ হয়। ডিসেম্বরে সামান্য বেড়ে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়।

এদিকে, ২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। প্রতি মাসেই কমতে কমতে গত মে মাসে তা ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তারপর থেকে ঋণ প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই করোনার ধকল কাটিয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি। গত চার মাস ধরে ধীরে ধীরে বাড়ছে এই ঋণ প্রবৃদ্ধি। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো, গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এই সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছেন। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।

এদিকে, করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ সুবিধা নিয়ে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য যথা সময়ে শুরু করা যায়, সেজন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহামারি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত এক লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং কটেজ মাইক্রো ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (সিএমএসএমই) ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল অন্যতম। এই দুই তহবিলের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা (১৫ হাজার ও ১০ হাজার কোটি টাকা) জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.