বাণিজ্যের আড়ালে ৬ বছরে সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার

বাণিজ্যের আড়ালে আমদানি-রফতানিতে মূল্য কম-বেশি দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-২০১৫ সালের মধ্যে (২০১৪ সাল বাদ দিয়ে) ছয় বছরে পাচার করা হয়েছে প্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।
আমদানি-রফতানিতে পণ্যের মূল্য ঘোষণায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাণিজ্যের নামে দেশ থেকে অর্থ পাচারের এই তথ্য উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে।
গত বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) জিএফআই বাংলাদেশসহ ১৩৪টি দেশের অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেখানে অন্য দেশগুলোর হালনাগাদ তথ্য থাকলেও বাংলাদেশের তথ্য আছে ছয় বছর আগের, ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এতে আবার ২০১৪ সালের হিসাব নেই।
তবে ২০১৪ সাল বাদে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের যে তথ্য দিয়েছে জিএফআই।
সংস্থাটি বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সালের হিসাব বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৩৪ দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি (১ ট্রিলিয়নে ১ লাখ কোটি) ডলার পাচার হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে চীন থেকে। এর পরই আছে পোল্যান্ড, ভারত, রাশিয়া ও মালয়েশিয়া। দুটি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে- ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং। তবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ২০১৫ সালের তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। কারণ এ সময়ের পর জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যের কোনো তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ ছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হয়েছে।
বিশ্বের ১৩৪টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের গত ১০ বছরের (২০০৯-২০১৮) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, সেই চিত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ৩৬টি উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে এতে। আমদানি-রফতানিকারকরা পণ্য আমদানি-রফতানির সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কমবেশি দেখানোর মাধ্যমে অর্থ পাচার করে।

পণ্যের প্রকৃত মূল্য ও ঘোষিত বা দেখানো মূল্যের তারতম্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জিএফআই। প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৬টি উন্নত অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাণিজ্যে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ব্যবধান চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়নি ওই প্রতিবেদনে। ২০১৫ সালের পর থেকে জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোনো তথ্য নেই। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে তথ্য দেয়া হয়েছে, সেটি ২০১৫ সালের আগের। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য সব দেশের যত আমদানি-রফতানি হয়, তাতে গড়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশের মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে।

জিএফআই হলো ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে প্রতি বছর তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.