৫০ বছরে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদ্ভাবনাময় ঝুড়িতে বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ বাংলাদেশ বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। এদিকে ৫০ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। যার কারণ বিদেশি বিশেষজ্ঞরাই বলছেন যে, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদ্ভাবনাময় ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। যার অর্থ উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন সাহায্য গ্রহীতা নয়, সাহায্যদাতার কাতারে উঠে এসেছে।

যদিও স্বাধীনতা অর্জনের পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল। যার অর্থ আজন্মকাল এ দেশ পরনির্ভরতার গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে না। কিন্তু গত ৫০ বছর পর এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। নানা আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে এই উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে। দিনেদিনে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। এটা আরোপিতভাবে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। এ সময়ে শিল্প খাতের অবদান কয়েক গুণ বেড়েছে। একইসময়ে বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে এসেছে এদেশ। এ সময় বেড়েছে, আমদানি রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, মাথাপিছু আয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণও।

বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রাথমিক যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে সময় জিডিপি’র আকার ছিলো ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। জিডিপি আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। আলোচ্য সময়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। অর্থাৎ ২ হাজার ৬৪ ডলার। দারিদ্রের হার ছিল ৭০ শতাংশ। দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ।

উন্নয়নশীল দেশের কাতারে
একসময় যে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত ছিলো এখন বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে দেশটি এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে। নানা চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এখন চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। এই অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এক মহান মাইলফলক।

ব্যাংক খাতের অবদান
অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের অন্যতম লক্ষ্য। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ প্রথমেই গুরুত্ব দেয় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় অন্যতম নিয়ন্ত্রক দেশের ব্যাংক খাত। এই খাতের উপর ভর করেই বাড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু। ব্যাংকের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে বিশাল উদ্যোক্তা শ্রেণি, যাদের হাত ধরে বিস্তৃত হয়েছে বেসরকারি খাত। স্বাধীনতাপূর্ব ১২টি ব্যাংক একীভূত হয়ে বর্তমানে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ছয়টি, বেসরকারি ব্যাংক ৪৩টি, বিশেষায়িত ব্যাংক তিনটি এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১০টি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক তাদের শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে শরীয়াহ ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ব্যাংক খাতই এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।

পাকিস্তানের দায় নিয়ে যাত্রা শুরু করা শূন্য রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমানতের পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকা। আর শূন্য থেকে শুরু করা বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকায়। এর ফলে বিপুলসংখ্যক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে বেসরকারি খাতে।

পুঁজিবাজারের অবদান
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো ডিএসই’র কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় তালিকাভুক্ত মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন ছিল ১৩ কোটি টাকা। গত ৪৫ বছরে এ বাজারে আরও ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকায়।

অর্থনীতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে গত এক দশক সময়ে। উদ্ভাবনী ক্ষমতার চর্চা এবং ডিজিটালাইজেশন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে আশা করা যায়। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের আর্থিক লেনদেনের সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া অনেকটাই জোরদার হয়েছে। ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে আর্থিক অন্তভুর্ক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।

দিনে দিনে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনিভাবে ব্যাংকের গ্রাহকের সংখ্যাও বেড়েছে। ব্যাংকের গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চমৎকার পরিবর্তন এনেছে। অতীতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেবার পরিধি শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি আগ্রহ ও তৎপরতায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকাতেও শাখা স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থিক সেবা দান অব্যাহত রেখেছে আরো অনেক আগে থেকে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো শাখা খোলার পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে তাদের আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসতে বেশ তৎপর হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর
বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভূক্ত হয় স্বাধীনতার ৫ বছর পওে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অনআতর্ভূক্ত হতে ৩টি শর্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোন দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদ- পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ সেই সুপারিশ পেয়েছে। জাতিসংঘের ৩টি শর্তের প্রথমটি হচ্ছে, মাথাপিছু আয়। এরপর অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং সবশেষে মানবসম্পদ উন্নয়ন। মাথাপিছু আয়ে জাতিসংঘের শর্ত পূরণে ন্যনতম দরকার এক হাজার ২৩০ ডলার। বাংলাদেশে সেখানে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। অর্থনৈতিক ঝুঁকি কতটা আছে, সেটা নিরূপণে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হয়। বাংলাদেশ সেখানে নির্ধারিত মানের চেয়েও ভালো করেছে। অর্থাৎ ২৫.২ স্কোর করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় দরকার ৬৬’র উপরে স্কোর। বাংলাদেশ সেখানে পেয়েছে আরো বেশি ৭৩.২ স্কোর।

তৈরি পোশাক খাতের অবদান
রফতানি এবং কর্মসংস্থান দুটো ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাতের বড় ভূমিকা আছে। বাংলাদেশ রফতানি করে এখন যে আয় করে তার ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যদিকে এ খাতে কাজ করে লাখ লাখ শ্রমিক যাদের সিংহভাগই নারী। তাদেরও জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ সব খাতেই পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় ভালো অগ্রগতি করেছে। বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর এক দেশ। আর্থিক ও সামাজিক সূচকে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আরো কিছু সূচকের তুলনা করলে দেখা যায় আসলেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে বহুদূর এগিয়েছে।

 

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.