সবার মতামতের ভিত্তিতে আয়কর আইন চূড়ান্ত করার আহ্বান

নতুন আয়কর আইন চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত রাখার সুযোগ দেওয়া উচিত। এজন্য তাড়াহুড়ো না করে আইনটি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আরও সময় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন  সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলেন, নতুন আইনটি এমনভাবে করা উচিত যাতে করদাতা ও রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে চোর পুলিশ খেলা বন্ধ হয়। বর্তমান আইনে এমন কিছু বিধি রয়েছে যা একদিকে করদাতাদের হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি করে। আবার অন্যদিকে কর ফাঁকিরও সুযোগ রয়েছে। ফলে করদাতা ও কর কর্মকর্তা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নতুন আইনে এই দু’পক্ষের মধ্যে যেন কোন দ্বন্দ তৈরি না হয় সেদিকে আরো বেশি মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান তারা।

আজ বৃহস্পতিবার আয়কর আইন-২০২২ এর ওপর আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন মতামত দিয়েছেন। ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি শারমীন রিনভী।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি  বলেন, আইনের ক্ষেত্রে প্রণয়নকারি, প্রয়োগকারি ও মান্যকারিদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। তা না হলে আইনের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এনবিআরের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, আয়কর আইনের মত আইনে মৌলিকতা আনতে সময় দরকার। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার অর্থনীতির দক্ষতা বাড়ছে কিনা, সাম্য নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা দেখা দরকার।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এনবিআরের প্রথম সচিব (আয়কর নীতি) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আয়কর এমন ব্যবস্থা এখানে বৈধ কাজ করলেও হয়রানি মনে হয়। ফলে করদাতাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। কর দিয়ে গর্ববোধ করতে হবে। দেশের মানুষ কর দিচ্ছে বলেই দেশ এগোচ্ছে।

তিনি বলেন, নতুন আইন বিষয়ে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও কাজটি দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছে। এজন্য মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করছে এনবিআর। কিন্তু এনবিআর মনে করে সকলের মতামত নিয়েই উপযুক্তভাবে আইনটি করা দরকার। এজন্য এনবিআর সময় নিয়েছে। তবে খুব বেশি দেরি করারও সুযোগ নেই।

আগাম কর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই যদি অক্টোবর নভেম্বরে এসে কর পরিশোধ করে, তাহলে বছরের বাকি সময় ব্যয়ের টাকা সরকার কোথায় পাবে। এজন্য আগাম কর, উৎসে কর নেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। অডিট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাত্র ৩ শতাংশ করদাতাকে অডিট করা হয়। ফলে করদাতাদের সিংহভাগই অডিটের বাইরে থাকেন। তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেয়। যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখছে। এনবিআর সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখেছে যে বিভিন্ন খাতে যে কর ছাড় দেওয়া হয়, তার পরিমান জিডিপির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বিল্ডের চেয়ারপার্সন আবুল কাশেম খান বলেন, দেশ বর্তমানে একটা রূপান্তরের পর্যায়ে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। এতে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা আসবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দেশের রফতানি পণ্যের সংখ্যা কম। এটা এক ধরনের দূর্বলতা। কর আইন, আমদানি রফতানি নীতির মত উদ্যোগের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এসব নীতিমালাতে দেশিয় উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে হবে। তিনি বলেন, এসব নীতিমালা করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা খুবই জরুরি। কিন্তু  আয়কর আইন চুড়ান্ত হওয়ার পথে। ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না। ব্যবসায়ীদের কাছে এনবিআরের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হলেও সময় দেওয়া হয়েছে খুবই কম। এজন্য আরও সময় প্রয়োজন।

তিনি বলেন, মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। কর হার বাড়ানো হলে কর ফাঁকির প্রবনতাও বাড়বে। এজন্য করের হার কমিয়ে আওতা বাড়ানো দরকার। তিনি আগাম আয়করকে (এআইটি) একটি ‘ব্যাড ল’ উল্লেখ করে বলেন, এনবিআর ধরেই নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায় না। ফলে আগেই কর কেটে নিচ্ছে। হয়ত কেউ কেউ কর ফাঁকি দিতে চায়। সেজন্য সবাইকে চোর ভাবলে তো হবে না। তিনি বলেন, করের অ্যাসেসমেন্টেও হয়রানি হয়। সবচেয়ে বেশি হয়রানি হয় অডিটে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলেও সাধারণ ব্যবসায়ীরা তা পারেন না।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোং এর পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, আইনটি বাংলায় হচ্ছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু বাংলার মধ্যেও কিছু শব্দ আছে যেগুলো বেশ কঠিন বা দূর্বোধ্য। এসব ধরনের শব্দের ক্ষেত্রে তিনি ইংরেজি শব্দও ব্যবহারের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের মুনাফায় কর ছাড় তুলে দেওয়া, সরকারি সিকিউরিটি কেনায় সীমা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি কর্মীদের বেতন ও কেনা কাঁচামাল মূল্য পরিশোধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আনার জন্য এবং নিবন্ধীনহীন ব্যবসায়ীদের থেকে কেনাকাটায় এমন কিছু ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা বাড়তে পারে। উৎসে করের হার না কমানোর ফলে কর্পোরেট কর কমানোর সুবিধা ব্যবসায়ীরা পাবেন না। যার ফলে তাদের করভার বাড়বে। এজন্য তিনি উৎসে করের হার পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান আইনে তৈরি পোশাক খাত ছাড়া অন্যান্য রফতানিকারকরা তাদের রফতানি আয়ের ৫০ শতাংশ কর ছাড় পান। প্রস্তাবিত আইনে এ বিষয়টি এবং সেবা রফতানিকারকদেও বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে এ ধরনের রফতানিকারকরা বাড়তি করের চাপে পড়বেন।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, কর ছাড় না দিলে পুঁজিবাজার এগোবে না। আবার আগামীতে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বন্ড মার্কেট লাগবে। ফলে নতুন আইনে এ বিষয়ে সুযোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দ্বৈত কর রয়েছে। যা ব্যবসার অন্যতম বাধা। হঠাৎ পরিদর্শন বন্ধ করা, ব্যবসায়ীদের গবেষণা ব্যয়ে কর ছাড়, বীমার প্রিমিয়ামকে ব্যয় হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, নতুন আইন নিয়ে এনবিআর আলোচনা বিশেষ করছে না। কিন্তু আলোচনা ছাড়া এত অল্প সময়ে এটা করা ঠিক হবে না।

মুক্ত আলোচনায় পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, কর নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতির দক্ষতা বাড়ানো। প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করা। তবে খসড়া আইনে এ বিষয়ে উৎসাহিত হওয়ার মত কিছু দেখছি না। আগামী দিনের অর্থনীতির যে কৌশল তাকে সহায়তা করতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়ন দরকার হবে। তবে নতুন আইনে সে সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। তিনি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ডিজিটাল কার্যক্রম বাড়ানো ও পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন।

এমসিসিআইর বোর্ড সদস্য হাসান মাহমুদ বলেন, বর্তমানে যেভাবে বড় শিল্পে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে তাতে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো সম্ভব নয়।

বারভিডা সভাপতি আব্দুল হক বলেন, শুধু নতুন আইন করলেই হবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংস্কার জরুরি। আয়কর আইনে কর কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা কমাতে হবে। অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের(আইবিএফবি) সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, করদাতারা রাজস্ব বিভাগকে বিশ^াস করে না। আর রাজস্ব বিভাগ করদাতাদেও বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাসের অবস্থান দূর করে আস্থাশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, দিনদিন করের বোঝা বড় হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নতুন উদ্যোগ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।

আইসিএবির সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে আরো নিয়ে আইনটি চ’ড়ান্ত করা দরকার।

আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলা আইন প্রয়োজন। পাশাপাশি আয়কর আইনে পরিবর্তনও দরকার। তবে পরিবর্তন যেনো সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি না করে। তিনি বলেন, নতুন আইনটি এনবিআর না করে, নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করাই ভালো হবে।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশ এগোচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে নতুন আয়কর আইন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন আইনটি অবশ্যই করদাতা ও ব্যবসা বান্ধব হতে হবে।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.