সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমায় স্বস্তিতে সরকার

সুদের হার কমানো এবং কেনার ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিধিনিষেধ আরোপের কারণে বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমে গেছে। এই খাতে দীর্ঘদিন জোয়ারের পর এবার ভাটার টান পড়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও স্বস্তিতে রয়েছে সরকার।

বিগত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বেশি হলেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে। এ সময় পুরনো সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এই খাতে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ কম। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে সরকার সম্প্রতি বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এছাড়া মহামারি করোনার কারণে মানুষের আয় এবং সঞ্চয় দুটোই কমেছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগও কমেছে। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারকে কম ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝাও কমে আসবে। তাদের মতে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর সুদের হার কমানো ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় ছিল না। এখন বিক্রি কমে আসবে, সরকারকেও বেশি সুদ পরিশোধ করতে হবে না।

এদিকে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো এবং অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপের ফলে অস্বস্তিতে পড়েছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। কেননা এমন অনেকেই আছেন যারা কেবলমাত্র সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর নির্ভর করেই পুরো মাসের ব্যয় পরিচালনা করেন। তারা বলেন, সরকারের এসব সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের জীবনযাপন আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, পেনশনের পুরো টাকাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিলাম। সেই টাকাতেই সংসারের পুরো খরচ চলে। এখন সুদের হার কমে যাওয়ায় খাবার এবং ওষধ কেনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়্ওে কাটছাট করতে হচ্ছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য প্রতিবছর বাজেটে সরকার লক্ষ্য ঠিক করে দেয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্যের চেয়ে বিক্রির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি হয়। সবশেষ গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, যা গেল অর্থবছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নিয়েছে সরকার।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের একক মাস অক্টোবরে মোট ৮ হাজার ৭২৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ হয়েছে ৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। মূল অর্থ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থ নিট বিক্রি হিসেবে গণ্য হয়। সেই হিসেবে আলোচিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ৭৬৬ কোটি টাকা।

বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্র থেকে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা নিট ঋণ নেয় সরকার। যেখানে গত অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ আসে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি ঋণ আসায় চলতি অর্থবছরে এ খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের শেষ দিকে এ খাতের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়। তবে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে সরকার মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ করায় এ খাতের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার নিচেই থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। বিক্রির অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এর বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দেয় সরকার। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এদিকে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেলেও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সুদ পরিশোধসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় বেড়েছে। ফলে রাজস্ব আয় ও বিদেশি অর্থ ছাড় বাড়লেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে ঘাটতি মেটাতে সরকার আবার ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের কোনো ব্যাংক ঋণ ছিল না। ওই সময়ে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল।

সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে সরকার। সবশেষ বাজেটে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র শুধুমাত্র সঞ্চয় অধিদফতরেই পাওয়া যাবে।

চলতি বছরের ১৮ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে জানানো হয়, এখন থেকে তফসিলি ব্যাংকের শাখা বা ডাকঘর থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। শুধু জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের আওতাধীন সঞ্চয় ব্যুরো থেকে এ সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সেজন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের সুদের কমিয়ে দিয়েছে সরকার।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম সুদের হার, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম হার এবং ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেক রকম হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হারে সরকার হাত দেয়নি। অর্থাৎ আগে যে হারে সুদ পাওয়া যেতো, এখনও সেই হারে পাওয়া যাবে।

এছাড়া, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মুনাফার হারে পরিবর্তন আনা হয়নি। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার সাড়ে ৭ শতাংশ। এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এর আগে ২০১৫ সালের ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার গড়ে ২ শতাংশের মতো কমিয়েছিল সরকার।

 

অর্থসূচক/এমএস/এএইচআর

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.