‘ড. কামালের নেতৃত্বে ভোটের মাঠে নামা রাজনৈতিক ভুল ছিল’

বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্য ‘ঘরবন্দী’ কর্মসূচিই দায়ী— এমনটি মনে করছেন দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। দলের শীর্ষ নেতাদের প্রেস ক্লাব ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের হলরুমের কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজপথে নামতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে রাজপথের কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে শীর্ষ নেতাদের আহ্বান জানান বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা।

এছাড়াও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ভোটের মাঠে নামাকে ‘রাজনৈতিক ভুল’ বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তারা বলছেন, এবার আন্দোলন বলেন কিংবা নির্বাচন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বেই সব কিছু করতে হবে। ২০১৮ সালের মতো আর নেতা ‘হায়ার’ করা যাবে না। এ সময় অনেক নেতা প্রশ্ন করেন, কার বুদ্ধিত্বে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনকে ‘হায়ার’ করা হয়েছিল?

ধারাবাহিক বৈঠকের দ্বিতীয় দিন গতকাল বুধবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলের মধ্যম সারির নেতারা নিজেদের এ মতামত জানান। বিকাল ৪টায় এ বৈঠক শুরু হয়। যুক্তরাজ্য থেকে স্কাইপির মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তারেক রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন। পৌনে আট ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই বৈঠকে অংশ নেওয়া ১১০ জন সম্পাদক ও সহ সম্পাদককের মধ্যে ৬০ জন বক্তব্য রাখেন।

রুদ্ধদ্বার বৈঠক সূত্রে জানা যায়, দলটির নেতারা বলেন, আমাদের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এরপর বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই দাবি আদায়ে বিষয়ে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। আন্দোলনের বিকল্প নেই।

নেতারা বলেন, আন্দোলনে নামার আগে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মাঝে একটি আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে, দেশের কোথাও কোনো নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হলে একযোগে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে বিএনপি এবং তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের কমিটিতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিটি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে হবে।

বিএনপি নেতারা বলেন, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল ও মহিলা দলকে সক্রিয় রাখতে হবে। পুনর্গঠন ও রাজপথে রাখতে অভিজ্ঞ নেতাদের দিয়ে সুপার ভিশন করতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করতে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অটুট রেখে ডান-বামসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, পেশাজীবীসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ১৯৯০ এর মতো এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যেভাবে জোটগত এবং যুগপৎ আন্দোলন সেই ধরনের আন্দোলন করে এ সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অটুট রেখে বৃহত্তর ঐক্য কীভাবে সৃষ্টি করা যায় তা নিয়ে এখনই কাজ শুরু করে দিতে হবে।

রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নব্বইয়ের আন্দোলনে ছাত্রদল নেতা কর্মীদের মধ্যে এমন কোন পরিকল্পনা ছিল না যে, এমপি হব, মন্ত্রী হব। প্রতিজ্ঞা ছিল স্বৈরাচারকে হটাতে হবে। এজন্যই আন্দোলনে সফল হয়েছিল। কিন্তু এখন তো ছাত্রদলের বা অঙ্গ সংগঠনের থানা পর্যায়ের যদি যুগ্ম আহ্বায়কও হয় সে বলে, এই এলাকা থেকে আসলাম। এই এলাকা শব্দটা আগে ছিল না। এখন যুদ্ধে জয় হওয়ার আগেই যদি গণিমতের মাল ভাগাভাগি করি, তাহলে তো ভাগাভাগির মধ্যেই থাকবো, আন্দোলন হবে কিভাবে বা সংগঠনই হবে কিভাবে।

বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে নেতৃত্ব হায়ার করা হয়েছিল। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। আমাদের দলের প্রাণ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তারা জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক। তাদের সামনে রেখেই আমাদের চলতে হবে। সরকারে গেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ প্রশ্ন কেন আসবে? আন্দোলনে সফল হলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মামলা টিকবে না ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবেন। তা হলে সমস্যা কোথায়? আমাদের তো নেতৃত্বের সংকট নেই। আমাদের অন্যদের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্ত অন্যদের আমাদের প্রয়োজন নেই। আন্দোলন সংগ্রাম করে জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় যেতে চাই। এর নেতৃত্ব দেবেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। আমাদের নেতৃত্ব হায়ার করার কোনো প্রয়োজন নেই।

সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, হয় এস্পার, নয় ওস্পার। কারণ আমাদের নির্বাচন করতে দেয়নি। আবার এখন সরকার নতুন খেলা শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোন নির্বাচন হবে না। বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলনের যাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি যুগপৎ আন্দোলনের পরামর্শ দেন।

পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা জিকে গাউস বলেন, আমাদের এলাকায় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা গেলে বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তা হলে আমরা কি অন্য দল থেকে এসেছি? এগুলো দেখতে হবে। তার এলাকার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১১ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিই পূর্ণাঙ্গ নেই। বেশিরভাগ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ।

বিএনপির সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানসহ যেসব পদ শূন্য রয়েছে তা দ্রুত পূরণ করতে হবে। আর আন্দোলনের বিকল্প নেই। কিন্তু উদার মন নিয়ে এ সরকারকে সরানো সম্ভব নয়।

এই বৈঠকের মূলমঞ্চে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.