‘সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের কাঠামোগত সংস্কার জরুরি’

কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারী (সিএমএসএমই) খাতের উদ্যোক্তাদের বিকাশে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকরণে ঋণ প্রদানের কাঠামোগত সংস্কার ও বিশেষায়িত ব্যাংক স্থাপন, এসএসই ডাটাবেইজ প্রণয়ন, সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তাবায়ন এবং সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন কে টার্ম লোন হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

আজ মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং এসএমই ফাউন্ডেশন-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত “এসএমই প্রণোদনা প্যাকেজ হতে ঋণ প্রাপ্তির পদ্ধতি” শীর্ষক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

মতবিনিময় সভার স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, তিনি বলেন, শিল্পখাতে ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ম্যানুফ্যাকচারিং এ ৪৫% মূল্য সংযোজন করে সিএমএসএমই খাত, তবে প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং নীতিগত সহায়তার অভাবে সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের সম্ভাবনা ও কর্মদক্ষতার পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না।

তিনি বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় দেশে দীর্ঘমেয়াদে ছুটি এবং লকডাউনের ফলে সিএমএসএমই খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং স্থানীয় এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসএমই খাতে সামগ্রিকভাবে আয় হ্রাস হয়েছে প্রায় ৬৬% এবং প্রায় ৭৬% উৎপাদিত পণ্য অবিক্রিত থেকে গেছে।

ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়িক দক্ষতা, পণ্যের বহুমুখীকরণ, দক্ষ কর্মী ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, বাজারে প্রবেশাধিকার, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি, প্রযুক্তিগত দূর্বলতা, গুণগতমানের কাঁচামাল সরবরাহ এবং উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তার অভাব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পাওয়াসহ অন্যান্য নীতিগত সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন, জামানতের অভাব এবং প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ প্রদানে ব্যাংকের অনাগ্রহ ঋণ বিতরণে ধীরগতি এ কার্যক্রমকে আরো দীর্ঘায়িত করছে, যার ফলে এসএমইখাতের উদ্যোক্তারা নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন।

ঢাকা চেম্বারে সভাপতি জানান, সিএমএসএমই খাতের সুনির্দিষ্ট কোন ডাটাবেইজ না থাকায় এ খাতের সঠিক অবস্থা জানা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রথম থেকেই এসএমই কাজ করছে, এর পাশাপাশি এ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় আইনী সংষ্কার বাস্তবায়নে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, সেই সাথে এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোরারোপ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এখাতের উদ্যোক্তাদের অবশ্যই দেশের বিদ্যমান আইনী ও আর্থিক কাঠামোর সম্পর্কে সম্যক ধারণা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। দেশের উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকরণে ঋণ প্রদানের কাঠামোগত সংষ্কার একান্ত আবশ্যক বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। এছাড়াও এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, দেশে ব্যবসা পরিচালন সূচকে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষনে বিদ্যমান কর এবং শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে সফলতা অর্জনে প্রয়োজনীয় সংষ্কার ও সংস্থা সমূহের দক্ষতা বাড়ানো একান্ত অপরিহার্য।

বিশেষ অতিথি’র বক্তব্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, মাত্র দেড় মাসেই শুধুমাত্র এসএমই উদ্যোক্তাদের মাঝে ১২২ কোটি বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে, এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সরাসরি ঋণ প্রদান করা সম্ভব হলে, এখাতের উদ্যোক্তাদের আরো কার্যকর ভাবে ঋণ সহায়তা প্রদান সম্ভপর হতো। এখাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা নিশ্চিতকরণে তিনি দেশে একটি বিশেষায়িত এসএমই ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তিনি জানান, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার হতে এসএমই ফাউন্ডেশনকে প্রদত্ত ২০০ কোটি টাকা এখাতের উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। মফিজুর রহমান বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ ফেরতের হার অত্যন্ত সন্তোষজনক এবং বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ভাগ নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণের আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে এসএমই ফাউন্ডেশন’র সহকারী মহাব্যবস্থাপক সুমন চন্দ্র সাহা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের নিজস্ব তহবিল হতে ইতোমধ্যে দেশের ৪০টি জেলায় ২১৮৬ জন এসএমই উদ্যোক্তাদের মাঝে বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রায় ১২২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ৫২৪ জন। তিনি জানান, অর্থ বিভাগ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য এখাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে এবং করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা চালু, ব্যবসা পরিচালনার জন্য চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ঋণ, মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে ৪% হারে ঋণ সহায়তা প্রদান করা হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, মোট ঋণের নূন্যতম ৭০% উৎপাদন ও সেবাখাতের উদ্যোক্তাদের অনুকূলে বিতরণ করা হবে।

এ সময় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এনকেএ মবিন, এফসিএম, এফসিএ এখাতের উন্নয়নে একটি সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশনকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান এবং দেশের সেবা খাতের বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করেন।

ডিসিসিআই পরিচালক খায়রুল মজিদ মাহমুদ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠন হতে ঋণ প্রাপ্তিতে বিদ্যমান প্রক্রিয়া সহজীকরণ করতে হবে।

ডিসিসিআই পরিচালক মো. রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, সরকারের ক্রয় প্রক্রিয়ায় এসএমইদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে এবং করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অন্তত ৩-৫ বছরের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা খুবই জরুরী।

আইডিএলসি ফ্যাইন্যান্স লিমিটেড-এর হেড অব এসএমই সাইফোদ্দৌলা শামীম জানান, দেশে ৮০ লাখের বেশি এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছেন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে তাদেরকে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, প্রায় ৭০০ নারী উদ্যোক্তাকে ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করা হয়েছে।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.