অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনে নতুন সংকটে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা

বিশ্ব অর্থনীতি এখনো পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দেশের প্রতিটি শিল্পখাতই কঠিন এক সময় পার করছে। এরকমই এক সময় নৌপরিবহন অধিদপ্তর লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত এক নতুন আদেশ জারি করেছে যার ফলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে নতুন সংকটাবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক ২৩ আগস্ট জারি করা নতুন আদেশ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর ও বন্দরের আশেপাশে সমুদ্রে নোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সকল লাইটার ভেসেলকে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি’র সিরিয়ালভুক্ত হয়ে পণ্য বোঝাই ও খালাস করতে হবে। আদেশ অমান্যকারী নৌযান মালিক, মাস্টার ও নাবিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর ফলে চট্টগ্রাম থেকে ডব্লিউটিসি’র সিরিয়ালের বাইরে কোন জাহাজে বা নৌযানে পণ্য পরিবহনের সুযোগ থাকছে না। পণ্য পরিবহনের জন্য ২০১৩ সালের নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্প মালিকরা নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করে যে পণ্য পরিবহন করছেন সেটিও সীমিত হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, পুরো নৌযানের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় এক ধরনের বিশৃঙ্খলার তৈরি হবে এবং নিরবচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। উপরন্তু, ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বিভিন্ন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি কোনো সরকারি সংস্থা নয় অথবা কোন আধা-সরকারি সংস্থাও নয়। অথবা সরকারের কোন এজেন্টও নয়। ফলে তাদের সিরিয়ালভুক্ত হয়ে পণ্য পরিবহনের আইনগত কোন ভিত্তি নেই। তবুও তারা তাদের সিরিয়ালভুক্ত হয়ে পণ্য পরিবহনের নামে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করতে যাচ্ছে।
এর আগেও গত বছর নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বলা হয়েছিল যে কোনো লাইটার ভেসেলকে সরকারি অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও সমুদ্র অতিক্রমের (ক্রসিংয়ের) জন্য ডব্লিউটিসি’র অনুমোদন নিতে হবে। অন্যথায় ডব্লিউটিসি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। ওই চিঠি পাওয়ার পর শিল্প মালিকরা সোচ্চার হন এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাথে সভা করেন। মহা-পরিচালক নৌপরিবহন অধিদপ্তর স্বীকার করেছিলেন যে ওই নোটিসে কিছুটা ভুল ছিল যা পরবর্তীতে সংশোধন করে দেয়া হবে।
তখন এও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতিত সকল মালবাহী নৌযানসমূহকে ডব্লিউটিসি’র সিরিয়াল অনুসারে চলাচল করতে হবে। তবে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল যে নিজস্ব লাইটার ভেসেলের পরও অতিরিক্ত নৌযানের প্রয়োজন হলে তা ডব্লিউটিসি’র সিরিয়ালভুক্ত হয়েই নিতে হবে।
খাত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগেও একসময় ডব্লিউটিসি’র নৌযানের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হতো। ওই সময় এক নৈরাজ্যকর অবস্থার তৈরি হয়েছিল। একটু পেছনে তাকালে দেখতে পাওয় যাবে যে ২০০২ সালের পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তারা যে নৈরাজ্য করেছে তা ছিল কল্পনাতীত। যেমন, কোন পণ্যের মালিক নৌ-যান দিয়ে চট্রগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করতে হলে এই ডব্লিউটিসি নামের সংগঠন থেকে নৌযান ভাড়া নিতে হতো। তাদের নির্ধারিত ভাড়ায় বাধ্য হয়েই মালিকরা পণ্য পরিবহন করত। পণ্য গন্তব্যে পৌঁছার পর খালাস করতে যেকোন কারণেই ৪ দিনের বেশি হলে পণ্যের মালিককে পেনাল্টি বা জরিমানা বহন করতে হতো। জরিমানার টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ডব্লিউটিসি পণ্য পরিবহন করা থেকে বিরত থাকত। স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া এবং জরিমানা পণ্য মূল্যের উপরই প্রভাব ফেলত। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক নৌ আইন অনুযায়ী যেকোন বৈদেশিক জাহাজ বর্হিনোঙরে অবস্থানকালীনের একটি সময় নির্ধারণ করা থাকে এবং ওই সময়ের মধ্যেই আমদানিকারকদের পণ্য খালাস করতে হয়। যদি দেরি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় পেনাল্টি বা জরিমানা আমদানিকারকদেরকে বহন করতে হয় যা ঐ সময় অর্থাৎ ২০০২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সকল পণ্যের আমদানিকারকদেরকেই বহন করতে হতো। এছাড়াও বর্হিনোঙরে লাইটার ভেসেলের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য যে পরিমাণ নৌযান থাকার কথা তারচেয়ে কিছুটা কম ছিল। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নৌ পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত ডব্লিউটিসি নামের সংগঠনটি। উভয় ক্ষেত্রেই অর্থাৎ বর্হিনোঙর থেকে সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত এবং সমুদ্র বন্দর থেকে গন্তব্য স্থান পর্যন্ত আমদানিকারকরা বাধ্য হয়ে ডব্লিউটিসি’র মাধ্যমেই পণ্য পরিবহন করত। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শিল্প-পণ্য এক বেকায়দা অবস্থায় পতিত হয়। একতরফা পরিবহন ব্যয় এটার মূল কারণ ছিল। পণ্য মূল্যের এমন অবস্থায় পৌঁছায় যা সরকারকে পর্যন্ত দোলা দেয়। তখন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগী হয়ে ঐ ডব্লিউটিসি সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয় এবং পণ্য উৎপাদনকারি বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের নিজস্ব কাঁচামাল পরিবহনের জন্য নৌ জাহাজ তৈরি করার অনুমতি দেওয়া শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে বাজারে পণ্য মূল্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে পূর্বের তুলনায় কমে আসে যা ভোক্তা সহায়ক পণ্য মূল্যে পরিণত হয়।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে বছরে প্রায় চার কোটি টন পণ্য লাইটার ভেসেলের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং করা হয়। ডব্লিউটিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন দেড় হাজার এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন প্রায় আড়াইশ লাইটার ভেসেল রয়েছে। এর বাইরেও চারশ’র মতো ভাড়া করা জাহাজে কারখানা মালিকরা পণ্য আনা নেয়া করেন। ডব্লিউটিসি’র তালিকাভুক্ত ৮০ জন লোকাল এজেন্ট জাহাজের এজেন্ট এবং ৩২ জন পণ্যের আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে পুরো ব্যাপারটি পরিচালনা করে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের কোথাও ছন্দপতন হলে পুরো দেশের পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও বহুলাংশে মুখ থুবড়ে পড়বে।
আরও উল্লেখ্য যে, খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুতকারী এবং সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো তাদের কাঁচামাল পরিবহন সুবিধার্থে লাইটার ভেসেলগুলো কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত নৌযান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা পণ্য মূল্য সীমিত রাখতে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর প্রেসিডেন্ট মোঃ আলমগীর কবির বলেন, শিল্প মালিকদের মালিকানাধীন লাইটার ভেসেলগুলোর প্রত্যেকটি শিল্পের লজিস্টিক সাপোর্ট হিসেবে অর্থাৎ ইন্ডস্ট্রির অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এইসকল নৌযান কোন ব্যবসায়িকভাবে বা কমার্শিয়ালি ব্যবহৃত হয় না। শিল্পের প্রয়োজনে এবং ভোক্তা সাধারনের কাছে প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিল্প পণ্য পৌঁছানোর স্বার্থে আমাদের ভেসেলগুলো সরাসরি আমাদের মাধ্যমেই পরিচালনা করতে দেয়া উচিত। দেশের ভোক্তা সাধারণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে যৌক্তিক পণ্য মূল্য নির্ধারণ করা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, সকলের মাঝে ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক বজায় রেখে সকলে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যাবেন এটি আমাদেরও প্রত্যাশা। সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বর্তমানে মোটেই ভালো নেই, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। আশা করি এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে না যাতে করে সিমেন্টের মূল্যের উপর প্রভাব পড়ে। আমরা ইচ্ছা করলেই সিমেন্টের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারিনা। এবিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু সহযোগিতা কামনা করছি।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.