বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। ইসরায়েলে তৈরি হ্যাকিং সফটঅয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এই নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৭টি সংবাদপত্র অনুসন্ধান চালিয়ে এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ফাঁস করেছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হাতে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি ডাটাবেস পৌঁছেছে, যেখানে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা রয়েছে।

‘পেগাসাস’ কী?
‘পেগাসাস’ হলো এক ধরনের সফটওয়্যার, যাকে বলা হয় ‘ম্যালওয়্যার’ বা বিশেষ ধরনের ভাইরাস। আইফোন ও অ্যানড্রয়েড ফোনে এই ‘ম্যালওয়্যার’-এর মাধ্যমে ফোনের সব খুদেবার্তা, ছবি, ই–মেইল, কল রেকর্ড জানা যায়। ‘পেগাসাস’ ফোন ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতে ফোন মাইক্রোফোন চালু করে দেয়।

যা জানা গেছে
‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘দ্য ওয়ার’-সহ ১৭টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী হাজার-হাজার মানুষকে নিশানা করা হয়েছিল। এই চাঞ্চল্যকর গণমাধ্যম প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মোট পঞ্চাশ হাজার ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। এই ফোন নম্বরগুলো বিশ্বজুড়ে এমনকিছু দেশের যেখানকার সরকার কোনো না কোনো সময়ে নাগরিক অথবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অথবা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের ওপর গোপন নজরদারির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। এমনকী এই দেশগুলোর মধ্যে বেশকিছু দেশের সরকার আবার ‘পেগাসাস’-এর নির্মাতা সংস্থা এনএসও’র কাছ থেকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সির প্রযুক্তি কেনার গ্রাহক। ধারণা করা হচ্ছে, এনএসওর গ্রাহকেরা ২০১৬ সাল থেকে এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি করা ম্যালওয়্যার ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে দেশে দেশে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ফোনে আড়ি পাতার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কোনো দেশে ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও আড়ি পাতা হয়েছে। বলা হচ্ছে, মূলত কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সরকার আড়ি পাতার কাজে এই ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করেছে।

পেগাসাসকাণ্ড তদন্তে সংবাদমাধ্যমগুলোকে নেতৃত্বে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং প্যারিসের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংবাদমাধ্যম ফরবিডেন স্টোরিস। বিশ্বের ১৭টি গণমাধ্যম এই অন্তর্তদন্তে অংশ নিয়েছিল। গণমাধ্যমগুলো বলছে— ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়ার অ্যাপ দিয়ে বিশ্বের দেশ দেশে গোপন নজরদারি চলছিল। পেগাসাস অ্যাপটিকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লাইসেন্সও দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।

এদিকে ‘এনএসও গ্রুপ’-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে— ‘পেগাসাস’ শুধু সরকারি ক্রেতাদেরই বিক্রি করা হয়। এনএসও কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ভুল কাজে জড়িত থাকার দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে বলেছে— ‘পেগাসাস’ কেবল অপরাধী ও জঙ্গি কার্যকলাপের ওপর নজরদারি চালানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা করা হয়েছে। যেসব দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত রয়েছে, কেবল সেসব দেশের মিলিটারি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাই যেন ‘পেগাসাস’ সফটওয়্যার পায়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ ছাড়া এনএসও’র দাবি— ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তদন্ত প্রতিবেদনে ‘ভুল ধারণা এবং প্রমাণবিহীন তত্ত্ব’ হাজির করা হয়েছে।

এদিকে, ১৭টি গণমাধ্যমের ‘পেগাসাস’ তদন্তে দাবি করা হয়েছে, যে পঞ্চাশ হাজার ফোন নম্বরের তালিকা অ্যাপটির ফাঁস হওয়া তথ্যে সামনে এসেছে, সেখানে অন্তত ৩৭টি এমন ফোন নম্বর রয়েছে, যার ওপর গোপন নজরদারি চালানোর যথাযথ প্রমাণ রয়েছে। গণমাধ্যমের চালানো এই অন্তর্তদন্তের প্রতিবেদনে এও দাবি করা হয়েছে— যে নম্বরগুলোর ওপর নিশ্চিতভাবে গোপন নজরদারি হয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু নম্বর সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তার।

এ ছাড়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, একাডেমিক, এনজিও কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা রয়েছেন। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরবের রাজপরিবারের সদস্যদের নম্বরও এ তালিকায় রয়েছে।

এ ছাড়া ফাঁস হওয়া ফোন নম্বরের তালিকায় মেক্সিকোর নিহত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সেসিলিও পিনেডা বিরতোর নম্বরও রয়েছে। গাড়ি ধোয়ার একটি জায়গায় এই সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল।

এর বাইরে এমন দুজন নারীর নম্বর তালিকাতে রয়েছে, যারা সৌদি আরবের খুন হওয়া সাংবাদিক জামাল খাসোগির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

এ ছাড়া আড়িপাতা হয়েছে বিশ্বের ১৮০ সাংবাদিকের স্মার্টফোনে। সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক, অনুসন্ধানী খবর করেন এমন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বিটে কর্মরত সাংবাদিকের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে। আড়িপাতার তালিকায় আছেন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, ফ্রান্স ২৪, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, মিডিয়াপার্ট, অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি), ব্লুমবার্গ, এএফপি, ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকাসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা।

গণমাধ্যমের এই অন্তর্তদন্তে শরিক ছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’। তারা দাবি করেছে— ‘পেগাসাস’-এর মাধ্যমে ভারতের অন্তত ৩০০ নম্বরের ওপর গোপন নজরদারি চলছিল। এর মধ্যে ৪০টি নম্বর হয় কোনো জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অথবা মানবাধিকারকর্মী অথবা সরকারি কর্মকর্তার। যে সব সাংবাদিকের নম্বরে নজরদারি চালানো হচ্ছিল তারা হিন্দুস্তান টাইমস, নিউজ ১৮, দ্য হিন্দু ও দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো বড় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত বলেও দাবি করেছে এই নিউজ পোর্টাল। এ ছাড়া ইন্ডিয়া টুডে’র নির্বাহী সম্পাদক শিশির গুপ্তও এই নজরদারির তালিকায় ছিলেন বলে জানানো হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার বলছে, ভারতে ফোনে নজরদারির তালিকায় রয়েছেন বহু ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানীও। দ্য ওয়্যার-এর তথ্য বলছে, বেশির ভাগ হ্যাক করা হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে।

যদিও ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার হ্যাকিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ভারত সরকার পালটা দাবি করেছে— ফোনে আড়িপাতা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, ভারত একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সব নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এই প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে ২০১৯ সালে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিল আনা হয়েছে।

এদিকে ‘পেগাসাস’-এর নির্মাতা সংস্থা এনএসও তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, তাদের তৈরি এই অ্যাপ কোনোভাবেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়নি। এনএসও দাবি করেছে- যেসব দেশ এই মুহূর্তে পেগাসাস ব্যবহার করছে, তাতে কেউ এর অপপ্রয়োগ করছে না। তবে যে ৫০ হাজার নম্বরের কথা সামনে আসছে, তা অন্য কোনো কারণে তাদের গ্রাহক দেশগুলোর সরকার ব্যবহার করলেও করতে পারে বলে জানিয়েছে এনএসও।

২০১৯ সালের অক্টোবরে খবরের শিরোনামে আসে পেগাসাস। সেখানে বলা হয়, সারা বিশ্বের প্রায় এক হাজার ৪০০ জনের ফোনে আড়িপাতা হয়েছিল। সে তালিকায় ছিলেন কূটনীতিক, নেতা, সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তারা। যদিও, সে সময় গোপন নজরদারির প্রসঙ্গটিকে পাত্তা দেয়নি ‘পেগাসাস’।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.