‘চায়না বিনিয়োগ বাড়লে রপ্তানিও বাড়বে’

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন শুধুই বড় রপ্তানিকারক নয়, বড় আমদানিকারক দেশও। বিশাল জনসংখ্যার কারণে দেশটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বাজারে পরিণত হয়েছে। দেশটি গত বছর গত বছর ২ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করেছে। অথচ এই বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব মাত্র ০.০৫ শতাংশ। চীনের বাজারের মাত্র ১ শতাংশ দখল করতে পারলেও সেদেশে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৫ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব।

বুধবার ‘বাংলাদেশ-চায়না ইকোনমিক এন্ড ট্রেড রিলেশনস ইন দি আফটারমাথ অফ দি কোভিড-১৯ গ্লোবাল পেন্ডামিক’ বিষয়ক ভার্চুয়াল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

আলোচনার মূল প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চীনে রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য পণ্য বহুমুখী করা ও গুণগন মান বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। চীন নিম্ন প্রযুক্তির নানা শিল্প থেকে বের হয়ে এসে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পের দিকে যাচ্ছে। ওই নিম্ন প্রযুক্তির পণ্যগুলো চিহ্নিত করে শূন্য জায়গায় রপ্তানির সুযোগ নিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে দেশটির নিম্ন প্রযুক্তির কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তরের। এখানে চীনা আইটি হাব স্থাপনের মাধ্যমেও রপ্তানির বড় সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।

ড. রাজ্জাক বলেন, তৈরি পোশাক, ফুটওয়্যারসহ চামড়াজাত পণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্যসহ বিভিন্ন খাতে চায়না বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে দেশটিতে সহজেই রপ্তানিও বাড়ানো সম্ভব হবে।

ব্যবহার এবং দেশটি থেকে অগ্রাধিকামূলক বাণিজ্য সুবিধা (এফটিএ) নিতে পারলে বাংলাদেশের জন্য চীনের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের আমদানি বাজারের কেবল ১ শতাংশ দখল করতে পারলেই বাংলাদেশ বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে পারবে। দেশটিতে বর্তমানে ১ বিলিয়ন ডলারের কম মূল্যের পণ্য ও সেবা রফতানি করে বাংলাদেশ।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (বিসিসিসিআই) যৌথভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান।

আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে বিসিসিসিআই সভাপতি গাজী গোলাম মর্তুজা, ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী, বিসিসিসিআই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা ও সিনিয়র সহসভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) শাহ মো. সুলতান উদ্দীন ইকবাল প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।

মূল প্রবন্ধে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছে ২০২৮ সালে চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হবে। অন্যদিকে চীন এখনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ। দেশটি বর্তমান বৈশ্বিক রফতানি বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। রফতানির পাশাপাশি চীনের আমদানি বাজারও বেশ বড়। সর্বশেষ বছরে দেশটি ২.৬৯ ট্রিলিয়ন ডলার রফতানির বিপরীতে ২.৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপুল ভোক্তা বাজারে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, চীন বৈশ্বিক বাজার থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ এখন তার মাত্র ০.০৫ শতাংশ সরবরাহ করছে। এটি যদি ১ শতাংশে উন্নীত করা যায় তবে চীনের বাজারে অতিরিক্ত ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে ড. রাজ্জাক বলেন, তৈরি পোশাকের বাজারের জন্য চীন একটি বড় আমদানি কেন্দ্র হিসাবে রুপান্তরিত হচ্ছে। চীনের আরএমজি বাজারের বতর্মানে ৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। যেখানে ভিয়েতনামের দখলে ১৯ শতাংশের বেশি। এখানে একটু নজর দিলেই বিশাল বাজার খুজে পাবে বাংলাদেশ।”

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে দেশটিতে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিপুল সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন টিপু মুন্সি।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেন, চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। গত বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মোট বাণিজ্য ছিল ১২.০৯ বিলিয়ন। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ১১.৪৯ বিলিয়ন এবং চীন থেকে বাংলাদেশের রফতানি ৬০ মিলিয়ন। উভয় দেশের বর্তমান বাণিজ্য সম্পর্ক চীনের পক্ষে। ২০২০ সালে চীন আমাদের জন্য ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও বাণিজ্যে সুবিধা করতে পারবে বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীনের সফর বাণিজ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। ওই সফরে উভয় দেশের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তিনি বলেন, উভয় সফরেই আমরা এফটিএ নিয়ে কথা বলেছি। এর কিছু অগ্রগতিও রয়েছে। তবে এটি দ্রুত বাস্তবায়নে আমাদের আরো প্রচেষ্ট চালাতে হবে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আগেই এটি হবে এবং বাংলাদেশ এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে মোকাবেলা করবে আমি আশাবাদি।

বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুক্তবাজার অর্থনীতি বেশ কার‌্যকর জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেন, উন্নয়নশীল দেশ থেকে বের হয়ে উন্নত দেশ হতে বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ আমাদের লক্ষ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। সরকারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নানা সুবিধা দিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এটি আমাদের প্রাইভেট খাতকে প্রতিযোগী সক্ষম হতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে জানিয়ে ওই দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন দেশটির নিযুক্ত বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর লি জিমিং।

চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশির সম্পর্ক বহুদিনের। ৪৫ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের লেনদেনে সুষম গতি বজায় রয়েছে। অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে সহায়তা ক্রমাগত গভীর হচ্ছে। গত বছরের জুলাইতে বাংলাদেশকে ৯৭% শতাংশ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। ফলে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য এটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে চীনের পণ্য আমদানি ২৮ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি আরো বাড়বে। দুই দেশের বানিজ্যে ব্যালেন্সড তৈরি হবে।

তিনি বলেন, উভয় দেশের বাণিজ্য বাড়াতে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াও এফটিএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে আরো বেশি কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে লি জিমিং বলেন, এই  ‍মুহুর্তে চীনের অভ্যন্তরে কারোনা ভ্যাকসিনের বিপুল চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সরবরাহও খুব সীমিত। এর মধ্যেও বন্ধুত্বের কারণে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। এরই মধ্যে সিনোফার্মের ৫ লাখ টিকা উপহার দিয়েছে। সিনোভ্যাকের উপহারের আরো ৬ লাখ টিকা আসার অপেক্ষায় রয়েছে।

“আমরা এখন চীনের ভ্যাকসিনের প্রকিউরমেন্টের বিষয়টি নিয়ে অপেক্ষা করছি। বাংলাদেশ-চীনের যৌথ উৎপাদনের আলোচনার অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক,” যোগ করেন চীনের রাষ্ট্রদূত।

চীন বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে জানিয়ে লি জিমিং বলেন, বিআরআই-এর অধীনে চীন বিভিন্ন উপায়ে যেমন অগ্রাধিকারযোগ্য ঋণ, বিনিয়োগ, প্রকল্প চুক্তি ও বিনামূল্যে সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। শুধু এসব খাতই নয়, ফাইভ জি, হাই স্পীড রেল, মহাকাশ এবং ব্লু -ইকোনোতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য নির্মূল, মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে চীনের কাজ করার আগ্রহ রয়েছে।

অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, চীন-বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রাচীণকাল থেকেই রয়েছে। সিল্করুট থেকে বর্তমান ডিপ্লোমেটিক সময়ে এ সম্পর্ক আরো বেড়েছে।  ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হওয়া আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন একটি মজবুত ভীতের ওপর রয়েছে। বাণিজ্যের পাশাপাশি আমাদের বড় বড় প্রকল্পে চীনের সহায়তা উভয় সম্পর্কে নতুন যোগ করেছে। বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অবকাঠামো, টেলি যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানীসহ প্রায় সব খাতেই চীনের বিনিয়োগ এসেছে। পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক এর মধ্যে অন্যতম। তবে চীনের এখনো বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর উভয় দেশ সফরে আলোচনা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে। এখন পযন্ত আমরা ২ বিলিয়ন বিনিয়োগ পেয়েছি। এ খাতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিনিয়োগ বাড়ানো সুযোগ রয়েছে।

চীনে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর মাহবুব উজ জামান বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক পুরানো। চীনের বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিশ্রতিও আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের। চীনের প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে যে ‘দ্য বেল্ট এন্ড গ্রোথ ইনিশিয়েটিভ’ ঘোষণা করেছেন। এই ইনিশিয়েটিভ চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তিনি বলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর বিনিয়োগের যে প্রতিশ্রতি এসেছে তা বাস্তবায়ন হলে উভয় দেশের বাণিজ্যে নতুন রূপ নেবে। বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কাজ করছি।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.