মূলধন ঘাটতিতে ১১ ব্যাংক

ব্যাংকগুলো গ্রাহক থেকে আমানত নিয়ে ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে সেই অনুপাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। তবে দেশের সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংক সেই অনুপাতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক।

এর মধ্যে সরকারি ৫টি, বিশেষায়িত দুটি ও বেসরকারি খাতের ৪টি ব্যাংক রয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ শেষে মূলধন সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংক; বেসরকারি খাতের এবি, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক ও পদ্মা ব্যাংক। এছাড়াও রয়েছে বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমান নিয়মে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ ন্যূনতম মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এ শর্ত পূরণে ডিসেম্বর শেষে ব্যর্থ হয়েছে উপরোক্ত ১১টি ব্যাংক।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকিং খাত ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। এতে করে দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এ সংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, খেলাপিরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিলেও ঋণ পরিশোধ করছে না। আর ঋণ আদায় না হলে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে কীভাবে। এটি ব্যাংক খাতের জন্য খারাপ দিক।

তিনি বলেন, বেশিরভাগ সরকারি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এর মূল কারণ তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তারা ইচ্ছেমতো ব্যাংক চালাচ্ছে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দিচ্ছে। এটি চলতেই থাকবে, যদি না কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন না হয়। এজন্য সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হয়।

কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ঋণ আদায়ে এসব ব্যাংকের টার্গেট নির্ধারণ করে দিতে হবে জানিয়ে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে তারা সংশোধন না হলে পর্ষদ পরিবর্তন করতে দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বিবেচনায় গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখার কথা এক লাখ ১৮ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। তবে আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয়সহ ব্যাংক খাতে মূলধন রয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এতে করে সার্বিক উদ্বৃত্ত রয়েছে ১৬ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগের প্রান্তিক গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

এদিকে ২০১৬ সাল থেকে ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার বা আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হচ্ছে। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের আওতায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শূন্য দশমিক ৬২৫, ২০১৭ সালে ১ দশমিক ২৫, ২০১৮ সালে ১ দশমিক ৮৭৫ ও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এই বাড়তি পুঁজি সংরক্ষণের নির্দেশনা ছিল। এভাবে ন্যূনতম মূলধন এবং সংস্থান বজায় রেখে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হারের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১০ দশমিক ৬২৫, ১১ দশমিক ২৫, ১১ দশমিক ৮৭৫ ও ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীতি করার কথা বলা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ৪৬টির মূলধন সাড়ে ১২ শতাংশের ওপরে আছে। ঘাটতিতে থাকা ১১ ব্যাংকসহ ১৪ ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের পরিমাণ এর কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন বজায় রাখার পর বাফার আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হারে মূলধন রাখতে না পারে, সেই ব্যাংক কোনো নগদ লভ্যাংশ বা বোনাস দিতে পারবে না। তবে কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিয়ে বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারে।

সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে তার জোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ জোগান দেয় সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন জোগানের বরাবরই বিরোধিতা করে থাকেন অর্থনীতিবিদরা। এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে এ অর্থ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.