‘কঠোর লকডাউন’ চলছে ঢিলেঢালা

সর্বাত্মক লকডাউনের আজ সপ্তম দিন। এদিন চলাচল করছে গণপরিবহন বাদে অন্যান্য প্রায় সব যানবাহন। খোলা রয়েছে দোকানপাট, বাজারগুলোতে নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই। তবে, পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘মুভমেন্ট পাস’ আর জরুরি সেবার সাথে জড়িত ছাড়া কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

সরেজমিনে আজ মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে কার্যতই দেখা গেলো ভিন্ন দৃশ্য। যেমনটি বলা হচ্ছে, তেমনটি আসলেই করা হচ্ছে না।

পুলিশের চেকপোস্টগুলোতে শুরুর দুইদিনের মতো এখন আর ততোটা কড়াকড়ি নেই। সবার পরিচয়ও জানতে চাওয়া হচ্ছে না প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অবাধে চলাচল করছে মানুষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, আসলে ‘ঢিলেঢালা লকডাউন’ বলাটা ঠিক হবে না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ১৮ শ্রেণির লোকের‘মুভমেন্ট পাস’ নেওয়ার দরকার হচ্ছে না। এছাড়া যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন বা অন্য কোনো জরুরি কাজে আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করছি।

তিনি বলেন, শপিং করার জন্য যে সময়টা বেঁধে দেওয়া হয়েছে সে সময়টাতেও অনেকে বের হচ্ছেন। এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিসটেটগন প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

কারওয়ান বাজার ট্রাফিক জোনের দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) কবির অর্থসূচককে বলেন, কিছু মানুষ রয়েছেন যারা নিয়ম-কানুনের বাইরে থাকতে চান, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যারা অনেক কম প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বের হচ্ছেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা অনেককে আটকও করছি।

শাহবাগ জোনের দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট অর্থসূচককে বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি। যারাই যাচ্ছেন তাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছি। এরপর যথাযথ মনে হলে আমরা তাদের যেতে দিচ্ছি। অনেককে নিয়ম ভঙ্গের জন্য শাস্তিও দিচ্ছি। অনেককে আবার সতর্ক করে ছেড়ে দিচ্ছি।

রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ও কাঁচাবাজারে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। এতে শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকছে না, মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধিও। অনেকে মাস্ক পরছেন না।

মিরপুর, কারওয়ান বাজার, গুলিস্তান, পল্টন, লালবাগবহ বেশ কয়েকটি এলাকায় কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের ভিড় সাধারণ দিনের মতোই। অনেক জায়গায় সরকারের নির্দেশনা মতো মাছ, মাংসের বাজার খোলা জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু বাড়তি উপস্থিতি থাকায় তাতেও শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকছে না।

নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের বক্তব্য ‘পেটের দায়ে’ বেরিয়েছেন তারা। ঘরে থাকার কোনো উপায় নেই। ঘরে থাকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

রিকশা চালক সাজিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। আমি কি করবো, আমার তো গাড়ি (রিকশা) চালানো ছাড়া উপায় নাই। যেটাই পাই এখন সেইটাই করি। তাও এখন ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে পারি না। যেখানে-সেখানে হাওয়া ছেড়ে দেয়। আটকে দেয়, চাকা ছিদ্র করে দেয়। আমাদের বলে আপনারা বাসায় গিয়ে বসে থাকেন। আমরা যে বাসায় বসে থাকবো, সরকার কি বাসায় খাবার পাঠিয়ে দেবে?

মাস্ক ছাড়া রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজন হোসেন। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, মাস্ক পরে রিকশা চালাতে পারি না। গরমে ভিজে যায়। মাস্ক খুলে থাকি মাঝে মাঝে। করোনা হলেও কিছু করার নাই। জীবন চালাতে হবে বলেই পথে নেমেছি।

প্রতিদিনই মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা বাড়লেও নিয়ম মানছেন না সাধারণ মানুষ। নানান অজুহাতে বের হচ্ছেন সবাই। গত টানা তিন দিন ধরে করোনায় মৃত্যু শতকের ঘরে। এ দিনগুলোতে (১৭-১৯ এপ্রিল) দেশে পর্যায়ক্রমে মৃত্যু হয়েছে ১০১, ১০২ ও ১১২ জনের। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

বাজার করতে বেরিয়েছিলেন হোসেন মিয়া। কারওয়ান বাজার এলাকায় তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমার বাসা এই সামনেই। এসেছি একটু বাজার করে চলে যাবো। ‘মুভমেন্ট পাস’ কি বুঝি না।

মো. হিমেল ঢাকা কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থাকেন শেওড়াপাড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে। লকডাউনে বাসা থেকে কেন বেরিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি টিউশনি পড়াতে যাচ্ছি মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে। শেওড়াপাড়া থেকে হেঁটে এসেছি পড়াতে যাব বলে। লকডাউনে সপ্তাহে দু’দিন পড়াতে হবে, নাহলে আমার টিউশনিটা চলে যাবে, এজন্যই বাসা থেকে বের হয়েছি।

ইমরান নামের একজন বলেন, আমি বেরিয়েছি আমার জরুরি কিছু দরকারে। আমি এই সামনেই থাকি। যদি বলেন, আগে কেন কিনিনি তাহলে বলবো, আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম। ওখান থেকে গতকাল আসছি। এজন্য আমি কিছু কেনাকাটা করতে পারিনি। দেখি আজ কিছু পাই কিনা। বেশিক্ষণ ওয়েট করবো না।

নাঈমুর রহমান ও শহীদুজ্জামান লকডাউনে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তারা বলেন, একজন যাবেন বিদ্যুৎ বিল দিতে। অন্যজন মোটরসাইকেল মেরামত করতে বের হয়েছেন। ‘কাজেই বের হয়েছি, তারপরও আমাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পুলিশ কোনো কথাই শুনবে না। শুধু বলছে, লকডাউনে কেন বের হলেন। এ কাজ তো আপনারা পরেও করতে পারতেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি ভালো হতে সময় লাগবে আরো কয়েকদিন। দুই সপ্তাহ পার হলে কমবে আক্রান্তের সংখ্যা আর তিন সপ্তাহ পর কমবে মৃত্যুর সংখ্যা। তাদের মতে, চলমান লকডাউন আর কয়েকদিন চললেই এবারের ঢেউয়ের চেইন ভেঙে যাবে। কমবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা।

ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন অর্থসূচককে বলেন, ‘আমরা তো আর লকডাউন দিলেই সাথে সাথে ফল পাবো না, এর জন্য কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কমপক্ষে দুই সপ্তাহ না যাওয়ার আগে কিছুই বলা যাবে না। এরপর সংক্রমণের ওপর প্রভাব পড়বে। তিন সপ্তাহ পর প্রভাব পড়বে মৃত্যুর ওপর।’

তার মতে এখনো মৃত্যুর হার কমেনি। ৫ এপ্রিলের লকডাউনের পর এখন সংক্রমণ চেইন স্থিতিশীল রয়েছে। এখন কাজ করছে ৫ এপ্রিলের দেওয়া বিধি-নিষেধের ফল। চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ ফল পাওয়া যাবে আরও কয়েকদিন পর।

তিনি বলেন, এখন সংক্রমণ স্থিতিশীল রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন পরীক্ষার তুলনায় ১৮-২০ শতাংশ লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা ৫ এপ্রিল বিধি-নিষেধের ‘ফল’। মৃত্যুর হারের ওপর প্রভাব দেখবো আমরা আরও এক সপ্তাহ পর। আমরা আশাবাদী এই লকডাউনের পর সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমবে।

প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় প্রথম দফায় গত ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়, যে বিধি-নিষেধের ধারাবাহিকতা চলে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। এটি শেষ হবে ২১ এপ্রিল। তার আগেই জাতীয় কমিটির লকডাউন বাড়ানোর সুপারিশে চলমান লকডাউন আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.