মহামারিতে আবার এলো বৈশাখ, স্বাগত ১৪২৮

স্বাগত, নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৮। আজ সকালে বাংলা নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয়ে একটিই কামনা সবার, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ প্রতিকূল বৈশ্বিক মহামারি করোনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে জাতি জেগে উঠেছে এই নতুন দিনের ভোরে, নতুন করে বেঁচে ওঠার কামনা নিয়ে। ঘরে থাকলেও আজ সকালে নতুন প্রেরণার সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে বাঙালির চোখেমুখে, বৈসাবির আবাহনে দুলছে আদিবাসী, আলোর প্রত্যাশায় চোখ তুলছে বিশ্ববাসী।

আজ বুধবার (১৪ এপ্রিল) সূর্যের নতুন আলোর সঙ্গে এসেছে নতুন বছর, বঙ্গাব্দ ১৪২৮। তাইতো এখন সবার মুখে একটিই সুর বাজে- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’

বৈশাখ আমাদের মনের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এ স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। তাইতো আজ প্রভাতের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন দিনের স্বপ্ন, সম্ভাবনা। সব পুরাতনকে সরিয়ে বৈশাখের রুদ্ররূপের হাত ধরে আসবে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ দিনটিতে প্রাণের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে আমরা বাঙালিরা মেতে উঠি আমাদের প্রাণের উৎসবে। হাজারো প্রাণের মেলবন্ধন হয় এই আয়োজনে। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এক মোহনায় মেলে। গায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান। রুদ্ররূপ বৈশাখকে সুরে সুরে আবাহন করি। তাইতো করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাঙালির জীবনে আরো একবার বৈশাখ এলো অগ্নিস্নানে সুচি হওয়ার বার্তা নিয়ে। ঠিক যেনো ‘কাল ভয়ংকরের বেশে এবার ওই আসে সুন্দর’
করোনা পরিস্থিতিতে বুধবার (১৪ এপ্রিল) সারাদেশে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। ফলে এবার পহেলা বৈশাখে হচ্ছে না জমকালো কোনো বর্ষবরণের আয়োজন। গত বছরও মানুষ ঘরে আবদ্ধ ছিল, এবারও বৈশাখ বরণে মেতে ওঠা হবে না। তবে এবারের বৈশাখে নিশ্চয়ই বিশ্ব জুড়ে করোনার সংক্রমণের কারণে যে ‘লকডাউন’ চলছে তা থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান ফুটে উঠবে সবার প্রার্থনায়। তাইতো এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যও নির্ধারণ করা হয়- ‘কাল ভয়ংকরের বেশে এবার ওই আসে সুন্দর’।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি।

পহেলা বৈশাখ এলেই পরস্পরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন, ব্যবসায়ীর অর্থ পরিশোধ করা, হালখাতা খোলার সেই চিরায়ত দৃশ্যগুলো ঘুরপাক খায়। বৈশাখ মানে গ্রামে ও শহরে মেলায় মানুষের ভিড়। বৈশাখী মেলার অন্যতম অনুষঙ্গ পুতুল নাচ, হাতি-ঘোড়ার সার্কাস, বায়স্কোপ। কোথাও আবার দেখা মেলে লাঠিখেলা, পালাগান, কীর্তনের আসর, নৌকা-বাইচ বা মাঠে কুস্তিখেলার দৃশ্য। করোনার জন্য এই দৃশ্যগুলো গত বছর দেখা যায়নি। এবারও কোনো আয়োজনের সুযোগ নেই।

কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চন্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়ার পর প্রথমদিকে ফসলি সন নামে পরিচিত হলেও পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে।

পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

১৯৮৭ সালে শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম ও হিরন্ময় চন্দের উদ্যোগে হাতি-ঘোড়া, পাখপাখালির আদলে তৈরি পুতুল দিয়ে যশোরে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে ১৯৮৯ সালের দিকে শোভাযাত্রাটি চালু হয়। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.