প্রণোদনার কৃষিঋণ, অর্ধেকও বিতরণ করতে পারেনি ২৩ ব্যাংক

করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা তহবিল গঠন করে সরকার। এই খাতে আশানুরুপ প্রণোদনার ঋণ বিতরণ না হওয়ায় কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে কৃষকদের মধ্যে ঋণ দিতে সবশেষ চলতি মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রণোদনার এই কৃষিঋণ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও বিতরণ করতে পারেনি দেশের ২৩টি ব্যাংক। আর সব মিলিয়ে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৭১ দশমিক ২৬ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কৃষি খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অবহেলা রয়েছে। তাই তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রণোদনা ঋণের আওতায় লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ করেছে বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংক। এই ব্যাংকের বরাদ্দকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি টাকা, যার বিপরীতে পাঁচ কোটি টাকার ঋণও বিতরণ করতে পারেনি ব্যাংকটি। এরপর রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটিতে বরাদ্দকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ কোটি টাকা, যার বিপরীতে বিতরণ হয়েছে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর লক্ষ্যমাত্রার তৃতীয় সর্বোচ্চ কম ঋণ বিতরণ করেছে স্টান্ডার্ড ব্যাংক। ব্যাংকটির বরাদ্দকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬১ কোটি টাকা, এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ছয় কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানান, কৃষিঋণের পরিমাণ কম থাকায় অন্যান্য ঋণের চেয়ে এই ঋণ বিতরণে ব্যাংকের অনেক বেশি খরচ হয়। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা শহর পর্যায়ে হওয়ায় ঋণ দেওয়ার জন্য প্রকৃত কৃষকদেরও পাওয়া যায় না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকের উৎসাহ নেই। আমাদের দেশের ব্যাংকাররা যেখানে বেশি সুবিধা পান সেখানেই ঋণ বিতরণ করেন। ব্যাংকের যারা নীতি-নির্ধারক বা ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন তাদের অবহেলা রয়েছে এই খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে। কৃষকরা যদি ব্যাংক থেকে এই সুবিধা নিতে না পারেন তাহলে তারা কিভাবে কাজ করবেন। তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেও অসুবিধা হবে।

প্রণোদনার আওতায় যাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আবার অনেক কৃষকই তা পায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে দালাল চক্র রয়েছে যারা এই সুবিধা নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।

তথ্যে আরও দেখা যায়, অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৪১ দশমিক ০৯ শতাংশ কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে ইউনিয়ন ব্যাংক। এছাড়া ৪২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বিতরণ করেছে দি সিটি ব্যাংক, ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ সাউথইস্ট ব্যাংক, ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক, ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ সোশাল ইসলামি ব্যাংক, ৩৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ সীমান্ত ব্যাংক, ৪১ দশমিক ০২ শতাংশ পূবালী ব্যাংক, ৪৩ দশমিক ২০ শতাংশ ওয়ান ব্যাংক, ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, ৪৪ দশমিক ৮০ শতাংশ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক, ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ন্যাশনাল ব্যাংক, ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ২০ দশমিক ০৩ শতাংশ যমুনা ব্যাংক, ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ ফার্স্ট সিউিরিটি ইসলামি ব্যাংক, ৩১ দশমিক ০১ শতাংশ ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ ঢাকা ব্যাংক, ২৬ দশমিক ৯০ শতাংশ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ২৭ দশমিক ২২ শতাংশ আল-আরাফা ইসলামি ব্যাংক ও ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বেসিক ব্যাংক।

এর আগে কৃষকের জন্য ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ নামে বিশেষ তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার সময় চলতি মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ফেব্রুয়ারি শেষে এক লাখ ৫১ হাজার ৭১৭ জন কৃষকদের মাঝে মোট প্রণোদনার ৭১ দশমিক ২৬ শতাংশ ঋণ দিতে পেরেছে ব্যাংকগুলো।

তথ্যে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটি ৮১ হাজার ৪৭৯ জন কৃষককে মোট এক হাজার ৬১৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকার প্রণোদনা ঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৮ হাজার ৮৩০ জন কৃষকের মাঝে মোট ৪০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর দশ হাজার ৯৭৭ জন কৃষকের মাঝে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৯০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

গত বছরের ১২ এপ্রিল ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্যকালে করোনা ভাইরাসে কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরই কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন ও পরিচালনার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.