ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফাঁসানো হয়েছে, দাবি সামিয়া রহমানের

গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগে পিএইচডি ডিগ্রি বাতিলসহ তিনজন শিক্ষককে পদাবনতি দিয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পদাবনতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি নিজেকে নিরাপরাধ দাবি করে বলেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার’।

আজ সোমবার (১ মার্চ) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদিক সম্মেলনে সামিয়া রহমান জানান, তার বিরুদ্ধে একটি মহল নানা রকমের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর ফলে তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে।

সামিয়া রহমান তার যৌথ নামে লেখা হলেও কী কারণে তিনি নিরপরাধ বিষয়টি তুলে ধরেন সাংবাদিক সম্মেলনে। তিনি বলেন, আমি প্রশাসনের চাপে মুখ বন্ধ রেখেছিলাম গত চার বছর ধরে। যে লেখার কারণে আমাকে শাস্তির পেতে হলো এটা আমার লেখাই নয়। আমি শুধুমাত্র আইডিয়া দিয়েছিলাম মারজানকে।

‘আমি যে লেখা জমা দিয়েছি এটা ডিন অফিস, ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি আমার কাছে রিভিউয়ের কপিও আসেনি। মারজান আমার ছাত্র ছিল। এরপর কলিগ হয়। মারজান তখন নতুন শিক্ষার্থী, সে আমার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে একটি প্রকাশনা বের করতে চেয়েছিল। আমি তাকে শুধু আইডিয়া দিয়েছিলাম। সে স্বীকার করেছে এটি তার অনভিজ্ঞতাবশত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল। আমার প্রশ্ন মারজান নিজে তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া ও রিভিউ করার কথা বলার পরও কেন দালিলিক প্রমাণ অষ্পষ্ট বলে তদন্ত কমিটি? এ সংক্রান্ত প্রমাণস্বরূপ মারজানকে দেওয়া আমার মেইল পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।’

এই মেইলের অনুলিপি প্রতিবেদকের হাতে মেলে। এতে দেখা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে তিনি মেইলটি পাঠান।

অ্যালেক্স মার্টিন নামে যার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সামিয়া রহমানকে পদাবনতি দেওয়া হয়েছে, সেই নামে কেউ নেই বলে দাবি করেছেন সামিয়া। তিনি বলেন, যে অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যার পরিচয় (শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যালেক্স মার্টিন পরিচয়ধারী) দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে চিঠি এসেছে, সেই অ্যালেক্স মার্টিন বলেই তো ওই জার্নালে কেউ নেই এবং তারা এ ধরনের চিঠি পাঠায়নি। শিকাগো জার্নালের এডিটর নিজে এটি স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে তিনি জার্নালের সম্পাদকের সঙ্গে তার নিজের একটি মেসেঞ্জার কনভারসেশনের স্ক্রিনশট সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের দেন।

তিনি দাবি করেন, যে লেখাটির জন্য তিনি অভিযুক্ত, সেটি তিনি লিখেননি, কোথাও পাবলিশ হওয়ার জন্য জমা দেননি। তিনি আরেকজন অভিযুক্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তি পাওয়া ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানকে দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি মারজান নিজেও ট্রাইবুনালের কাছে স্বীকার করেছে। তবুও আমাকে কেন শাস্তির আওতায় আনা হলো? এটি ষড়যন্ত্র।

সামিয়া আরো বলেন, ওই প্রতিবেদনে আমার কোন স্বাক্ষর নেই। আমার স্বাক্ষর ছাড়া কেন এটি ছাপানো হলো? ডিন অফিসে লেখা জমা দেওয়ার পর, সেটি সম্পাদনা পরিষদ যাচাই-বাছাই করেন, তারপর রিভিউয়ারে কাছে যায়, রিভিউয়ার সেটি বাতিল বা গ্রহণ করলে বা সংশোধনের সুপারিশ করলে সেটি আবার সম্পাদনা পরিষদ বরাবর লেখকের কাছে যায়। লেখকের সংশোধনের পর সেটি আবার সম্পাদনা পরিষদ যাচাই-বাছাই করে ছাপার যোগ্য মনে করলে লেখাটি প্রকাশ করেন। এই লেখাটি প্রকাশনার জন্য এডিটোরিয়াল বোর্ডে দাখিল থেকে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত কোনো ধাপেই আমার কোনোরকম দালিলিক প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। এমনকি ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত বলছে ন্যায় বিচার হয়নি। অথচ প্রতিহিংসা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির শিকার হলাম আমি।

২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি আমি ডিন অফিসে গিয়ে লেখাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাই। যেটির কপিও তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল। সিন্ডিকেটে বিষয়টি তোলার জন্য তৎকালীন ভিসি ড. আরেফিন স্যার তাকে বারবার বলেন, আমি নিজেও ড. ফরিদ উদ্দীনকে বারবার সিন্ডিকেটে বিষয়টি তোলার অনুরোধ করলেও তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন সাত মাস, জানান পদাবনতি পাওয়া এই শিক্ষক।

সামিয়া রহমান আরো বলেন, আমি এমনই রাজনীতির শিকার যে- ড. আরেফিন স্যারকে ভিসির পদ থেকে সরানোর দু’দিনের মাথায় আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, এবার তিনি বিষয়টি সিন্ডিকেটে তুলবেন। আর ড. আরেফিন স্যার নাকি তাকে ১০ মিনিটের মাথায় ডিন পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মারজান তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এসব কিছুর প্রতিশোধ হবে এটি।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কিভাবে ট্রাইব্যুনাল আর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়? কেন ট্রাইব্যুনালের আহ্বায়ক নিজে গণমাধ্যমকে বলেন, ন্যায় বিচার হয়নি। প্লেজারিজম হয়নি। কেন আমাকে না দেখিয়ে আমার নামে লেখা প্রকাশ করে? কেন রিভিউয়ার ও এডিটরের শাস্তির সুপারিশ হওয়ার পরও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়?

সামিয়া রহমান বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তনের অধিকার আমার ছিলো। এটি পরিবর্তনের জন্য ২০১৯ সালে চিঠি দেওয়া হলে বর্তমান ভিসি সেটি গ্রহণ করেননি। আর তদন্ত শেষ না করেই আমাকেই দোষী সাবস্ত করে কেন গণমাধ্যমে কথা বলেন তারা? এ পর্যন্ত অন্তত তিন বার রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত, ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত, তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত চেয়েছি আদালতে যাওয়ার জন্য, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো কিছুই দিচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, আমি ২০১৬ সালে আমেরিকা যাচ্ছিলাম। এসময় ডিন অফিস থেকে আমাকে ফোন দেওয়া হয়। বলা হয়, আপনার পাঠানো লেখা হারিয়ে গেছে। আমি যাতে পুনরায় তা পাঠিয়ে দেই। কিন্তু আমি তখন জানাই আমি কোনো লেখা পাঠাইনি। আমি ফোন করে মারজানকে লেখাটি বন্ধ করতে বলি। মারজান জানায়, রিভিয়ার কমিটি এটি গ্রহণ করেছে। এডওয়ার্ড সাঈদ ও মিশেল ফুকোর উদ্ধৃতি দেওয়া তাই জানতে চাই সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছিলো কী-না? মারজান আমাকে আশ্বস্ত করে সব ঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে। আমি তাকে বলি, আমি আমেরিকা থেকে না আসা পর্যন্ত যেনো লেখাটি না ছাড়ে।

এছাড়াও যৌথভাবে ছাপানো লেখাটি দেখিয়ে তিনি বলেন, এই লেখায় দুই লেখকের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ফুট নোট দেওয়া উচিত ছিল। মারজান সেটি করেনি। যদিও লেখার শেষে রেফারেন্সে তাদের নাম দিয়েছে। একটি একটি গবেষণা প্রবন্ধে ফুটনোট দেওয়া অবশ্যই উচিত ছিল।

সামিয়া রহমান আরো বলেন, আমি ষড়যন্ত্রেরে শিকার। যে লেখা আমার না, আমি শুধু আইডিয়া দিয়েছি। আমাকে না জানিয়ে ছাপা হলো। আমি নিজেই তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য আবেদন করলাম, সেখানে আমাকে দোষী সাবস্ত করা হলো। আমি রাজনীতির শিকার। এতোদিন তদন্ত চলায় আমি চুপ ছিলাম। এখন আমি আদালতে যাবো। আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে যা যা করা প্রয়োজন করব।

সংবাদ সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এবং আইনজীবী তুরিন আফরোজ।

প্রসঙ্গত, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমানকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদাবনতি দিয়েছে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া রহমান ও মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শিরোনামের আট পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। এটি ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’তে প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু নকল বলে অভিযোগ ওঠে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক লিখিত অভিযোগে মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই চুরির কথা জানিয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস। শুধু মিশেল ফুকোই নন, বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ গ্রন্থের পাতার পর পাতাও সামিয়া ও মারজান হুবহু নকল করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে গত বছর ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ২৯ অক্টোবর তাদের একাডেমিক অপরাধের শাস্তির সুপারিশ করতে আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহকে আহ্বায়ক করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শাস্তির বিষয়ে সুপারিশ জমা দিলে সিন্ডিকেটের সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অর্থসূচক/এইচএ/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.