মহামারির কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় কমে গেছে, কর্মসংস্থানও নেই অনেকের। মানুষ যখন এমনিতে আর্থিক চাপে আছে, তখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে।
বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনক মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, দেশে চাল উৎপাদনে রেকর্ড হচ্ছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানিও হচ্ছে। তবু কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, বিষয়টি খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।
আজ বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনার আওতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২১-২০২২, প্রথম অন্তবর্তীকালীন পর্যালোচনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সংবাদ সম্মেলনে ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু সরকারি সংস্থা বিবিএসের তথ্যে দাম বাড়ার কোনো প্রতিফলন নেই। কারণ হতে পারে, বিবিএস যেসব পণ্যের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) করে থাকে, সেটি অনেক পুরোনো। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের ভোগে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাই সময় এসেছে, ভোক্তা মূল্যসূচক করার জন্য নতুন পণ্যের বাস্কেট করতে হবে। কারণ, বাজারে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যে বেশ ফারাক দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বাস্তবতার সঙ্গে যার বিরাট ফারাক। আমরা মনে করি অতিমারীর সময়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এছাড়া ঋণের ক্ষেত্রেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
তিনি আরো বলেন, আমরা এখনো করোনা থেকে পরিত্রাণ পাইনি। অসংখ্য মানুষ করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। তাদের নগদ টাকা দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রতি পরিবারে চারজন সদস্য ধরে এক মাসে খরচ আসে ৭ হাজার ২৯৭ টাকা। যদিও সরকার থেকে দেওয়া হয়েছে আড়াই হাজার টাকা করে। নগদ টাকা আরও বেশি সময় ধরে দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রণোদনা হিসেবে নগদ টাকা দিয়েছে। সিপিডির পক্ষ থেকেও প্রান্তিক মানুষকে নগদ আট হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ লাখ পরিবার বাছাই করা হলেও সবাইকে নগদ টাকা দেওয়া যায়নি। সুবিধাভোগীর তালিকা বাছাই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। চালের দাম বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের বাজেটে সারের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে দাম বেড়েছে, তাতে ২২ হাজার থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। কিভাবে সমন্বয় করবে সরকার? আবার গ্যাসের দামও বাড়ছে। যেভাবে রাজস্ব আহরণ হচ্ছে, তা দিয়ে মূল্য সমন্বয় করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিদেশি বড় অর্থায়ন আসছে, এটা সত্য। তবে এটা কিন্তু বাজেটের সহায়তা নয়, প্রকল্পের সহায়তা। যেহেতু এটা বাজেটের সহায়তা নয়, তাই এটা দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় সম্ভব নয়। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনা–পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার টেকসই হচ্ছে না। টেকসই না হওয়ার কারণ হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থির। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোও স্বস্তিতে নেই। করোনা মহামারির আগেও এসব সমস্যা ছিল। এখন তা বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, চালের কী পরিমাণ চাহিদা, তার মূল্যায়ন করা দরকার। দেশে চালের ব্যবহার বাড়ছে। চালের ভোগ কত? তার সঠিক তথ্য নেই।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে চালের চাহিদা বেড়েছে। চালের বাণিজ্যিক ব্যবহারও বাড়ছে। ভোগের বাইরেও চালের ব্যবহার বাড়ছে। এসব বিষয় হিসাবে আনা দরকার। ঘাটতি টানাপোড়েনের সুযোগে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। কতিপয় গোষ্ঠী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সিপিডি বলেছে, সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা বড় বড় উদ্যোক্তারা পেয়েছেন। ঋণ খেলাপিরাও পেয়েছেন। প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা যাঁদের পাওয়ার কথা, তাঁদের কাছে টাকা পৌঁছায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ক্ষতিগ্রস্তরা প্রণোদনার টাকা পাবেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তের সংজ্ঞা কী? নীতিতে দুর্বলতা থাকার কারণে প্রণোদনার টাকা সঠিক জায়গায় যায়নি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রান্তিক মানুষের ওপর বেশি জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.