গতবছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২০২৫ সাল দেশের পুঁজিবাজারের জন্য ছিল অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতার বছর। বছরজুড়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং নীতিগত সংস্কারের ধীরগতির প্রভাব সরাসরি পড়েছে পুঁজিবাজারে। ফলে বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় বাজারের বাইরে অবস্থান করেছে। কমেছে বিদেশী বিনোয়েগের পরিমান।
বাজার মূলধন ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক
২০২৫ সালে বাজার মূলধন ও জিডিপির অনুপাত নেমে এসেছে ১২ দশমিক ২১ শতাংশে, যা আগের বছর ছিল ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। এই অনুপাতিক হ্রাসের ফলে সামগ্রিক অর্থনীতির তুলনায় পুঁজিবাজার কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রবাহ প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কমেছে।
সূচকের ধারাবাহিক পতন
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স (DSEX) ২০২৫ সালে শুরু করেছিল ৫ হাজার ২১৬ দশমিক ৪৪ পয়েন্টে, কিন্তু বছর শেষে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৮৬৫ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে। এতে সূচক কমেছে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
ডিএসইএক্সের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৬৩৬ দশমিক ১৫ পয়েন্ট, আর সর্বনিম্ন নেমে আসে ৪ হাজার ৬১৫ দশমিক ৪১ পয়েন্টে।
শীর্ষ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ (DS30) সূচকও ২০২৫ সালে শুরু করেছিল ১ হাজার ৯৩৯ দশমিক ৭৩ পয়েন্টে, কিন্তু বছর শেষে নেমে এসেছে ১ হাজার ৮৫৩ দশমিক ৫৪ পয়েন্টে। এতে সূচক কমেছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
ডিএসই-৩০ সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ২ হাজার ১৯৫ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট, আর সর্বনিম্ন নেমে আসে ১ হাজার ৭০৪ দশমিক ৩৬ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক সূচক ডিএসইএস (DSES)-এও নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থার কারণে এই সূচক বছরের বড় সময় চাপের মধ্যে থাকে। যা ছিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর আস্থাহীনতার প্রতিফলন। বছর জুড়ে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বড় শিল্প খাতের শেয়ারে দরপতন হয়েছে।
লেনদেনে বড় ধস
২০২৫ সালে মোট ২৪০ কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৮১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এটি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কম লেনদেন।
দৈনিক গড় লেনদেন নেমে আসে মাত্র ৫২১ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়, যেখানে ২০২৪ সালে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৬৩১ কোটি ৯৬ টাকা।
লেনদেনে ধস নামাতে উচ্চ সুদের হার, ব্যাংকে আমানতে ভালো রিটার্ন এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের লোকসানের অভিজ্ঞতা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করেছে।
ব্লক মার্কেটেও স্থবিরতা
২০২৫ সালে ব্লক মার্কেটের মোট লেনদেন দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৩৩ কোটি ৬১ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। মোট লেনদেনের মাত্র ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ এসেছে ব্লক মার্কেট থেকে। ফলে বড় বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় ব্লক মার্কেটেও গতি আসেনি।
বাজার মূলধনে সামান্য ইতিবাচক পরিবর্তন
সব নেতিবাচকতার মাঝেও ২০২৫ সালে বাজার মূলধনে সামান্য ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। বছর শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৮১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন টাকা, যা বছরের শুরুতে ছিল ৬ হাজার ৬২৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন টাকা। এতে বাজার মূলধন ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
বাজার মূল্যায়ন ও পিই অনুপাত
২০২৫ সালে বাজারের পিই (Price to Earnings) রেশিও কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৯ যেখানে আগের বছর ছিল ৯ দশমিক ৫০। কম পিই বাজারকে তুলনামূলকভাবে সস্তা দেখালেও আস্থাহীনতার কারণে নতুন বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় আসেনি।
সার্বিক মূল্যায়ন
২০২৫ সালকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা একটি “সংক্রমণকালীন বছর” হিসেবে দেখছেন। বাজারে কাঠামোগত সংস্কার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
তবে নীতিগত সংস্কার, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা গেলে আগামী বছরগুলোতে পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে পারে—এমন প্রত্যাশাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)-এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে সংস্কার না আসায় বাজারে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেকোনো সংস্কারের সুফল দীর্ঘমেয়াদে আসে এবং বাজার তা গ্রহণ করতে সময় নিচ্ছে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। দীর্ঘদিন বাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য পর্যাপ্ত রিটার্ন দিতে না পারায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা কাটাতে হলে বাজারে অগণিত নতুন ও ভালো শেয়ার আনতে হবে।
তিনার মতে, গত ১৫ বছরে বাজে শেয়ারে হওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভালো কোম্পানির আইপিও জরুরি। ২০২৬ সালে নতুন সরকার আসার পর ভালো কোম্পানির আইপিও বাড়বে—এমন প্রত্যাশা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাজারের এই পরিস্থিতির দায় সব পক্ষের। রেগুলেটর, স্টক এক্সচেঞ্জ, মধ্যস্থতাকারী ও বিনিয়োগকারী—সবার সম্মিলিত দায়িত্বহীনতার ফলেই পুঁজিবাজার এই অবস্থায় পড়েছে।
ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যানালিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আল-আমিন অর্থসূচককে বলেন, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের নেতিবাচক পরিস্থিতির প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেট আলাদা হলেও একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ব্যাংক মার্জার, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব বাজারে স্পষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বড় বিনিয়োগকারী ও ফান্ড ম্যানেজাররা নিষ্ক্রিয় থাকায় নির্দিষ্ট শেয়ারে নতুন বিনিয়োগ আসেনি।
তিনি বলেন, রিফর্মের পর কিছু স্টকে সাময়িক মুভমেন্ট হলেও বিনিয়োগকারীরা প্রফিট বুক করায় বাজার সামগ্রিকভাবে তলানিতে নেমেছে। ট্রেজারি বিল, বন্ড ও ব্যাংক সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগকারীরা ফিক্সড রিটার্নে ঝুঁকছে। পাশাপাশি আইপিও বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় নতুন ভালো কোম্পানি বাজারে আসেনি।
আল-আমিন মনে করেন, নতুন সরকার গঠনের পর ও নতুন বছরে ভালো কোম্পানি ও মানসম্মত আইপিও এলে বাজারে গতি ফিরতে পারে। তিনি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক বিশ্লেষণ, ধৈর্য ও গুজব এড়িয়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন।
তথ্যসূত্র-ডিএসই/বিএসইসি
অর্থসূচক/ আজম আলী খান



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.