সোনার বার ও কয়েনে বাড়ছে বিনিয়োগ, গয়না কেনায় হ্রাস

চলতি বছর বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ। এই বাস্তবতায় সোনার অন্যতম বৃহৎ বাজার ভারতে সোনার গয়না কেনার প্রবণতা কমেছে। যদিও তাঁদের সোনা কেনা কমেছে, বিষয়টি এমন নয়।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) রয়টার্সের এক প্রতিবদেন এ তথ্য নশ্চিত করেছে।

সোনার এই উচ্চদামের বাস্তবতায় ভারতীয়রা সোনার গয়না না বানিয়ে সোনার কয়েন কিনছেন। মুম্বাইয়ের গৃহবধূ প্রাচি কদম তেমন একজন। তিনি বলেন, সোনার যে দাম, তাতে গয়না বানানো বাবদ অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করার মানে হয় না, যদিও তিনি গয়না পরতে ভালোবাসেন। বাস্তবতা হলো, ভারতীয়দের কাছে সোনার গয়না কেবল স্টাইল বা সাজগোজের অনুষঙ্গ নয়; বরং উৎসবের সময় সোনার গয়না কেনা তাঁদের কাছে পবিত্র বিষয়।

চলতি বছর বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ২৬ ডিসেম্বর সোনার দাম সর্বকালীন রেকর্ড স্পর্শ করে—সেদিন প্রতি আউন্স সোনার দাম দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৪৯ ডলার। সেই সঙ্গে ভারতের বাজারে এ বছর সোনার দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। যেখানে দেশটির শেয়ারবাজারের মূল সূচক নিফটি ৫০ সূচকের উত্থান হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ভারতীয়দের কাছে সোনার দাম আরও বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, চলতি বছর ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতন হয়েছে ৫ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ভারতে সোনার চাহিদা কমেছে ১৪ শতাংশ। এ সময় গয়না কেনা কমেছে ২৬ শতাংশ। গয়না বিক্রি হয়েছে মোট ২৭৮ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে সোনায় বিনিয়োগ ১৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৫ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার ৪০ শতাংশের উৎস হচ্ছে বিনিয়োগ। এই প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, ভারতীয়দের কাছে সোনার গুরুত্ব কতটা।

দাম বাড়ায় বদলাচ্ছে কেনার ধরন
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয়দের সোনায় বিনিয়োগের এই প্রবণতা আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বুলিয়নের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বিশ্বজুড়েই অলংকারের বাজারে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে।

আবার যাঁরা সোনার কয়েন বা বার কেনার পক্ষপাতী নন, তাঁরা বরং কম ওজনের গয়না কিনছেন। কলকাতার নিবেদিতা চক্রবর্তী বলেন, বাজেট সোনার দামের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় তিনি হালকা ডিজাইনের দিকে ঝুঁকেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘সোনার হারের ওজন ছয়-সাত গ্রাম কমালেই এক লাখ রুপির বেশি সাশ্রয় হয়।’

পি এন গাডগিল জুয়েলার্সের চেয়ারম্যান সৌরভ গাডগিল বলেন, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতারা এখন গয়নার নকশা ও মূল্য—দুটি বিষয়েই আরও সচেতন হচ্ছেন। এই বাস্তবতায় ব্যবসায়িক কৌশলেও পরিবর্তন এনেছেন তিনি। গত জুন মাসে গাডগিল জুয়েলার্স হালকা ও কম ক্যারেটের গয়নার জন্য নতুন সাব-ব্র্যান্ড চালু করেছে।

সৌরভ গাডগিল আরও বলেন, ক্রেতারা গয়না কিনতে চান না, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু একই সঙ্গে দামের জন্য যেন চাপে পড়তে না হয়, সে বিষয়েও তাঁরা সচেতন। আধুনিক কারুশিল্পের কল্যাণে হালকা গয়না এখন আর কেবল আর কেবল শৌখিন পণ্য নয়, বরং এসব গয়না এখন কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে।

বিনিয়োগের প্রবণতা থাকবে
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয়রা গয়না কেনা কমিয়ে যে সোনার বার বা কয়েনে বিনিয়োগ করছেন, এই প্রবণতা ২০২৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ইন্ডিয়া বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পৃথ্বীরাজ কোঠারি বলেন, অন্যান্য সম্পদের তুলনায় সোনা থেকে ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে বলে এই প্রবণতা বাড়ছে। তাঁর ভাষায়, ক্রেতারা ধরে নিচ্ছেন, সোনার দামের এই ঊর্ধ্বগতি চলমান থাকবে। সে কারণেই তাঁরা কয়েন, বার কিংবা গোল্ড ইটিএফের মতো খাতে বিনিয়োগ করছেন।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতে তালিকাভুক্ত ও স্বর্ণভিত্তিক এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) এখন পর্যন্ত ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৩৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। পরিমাণের দিক থেকে তা প্রায় ২৮ দশমিক ৭ টন সোনা। ফলে এসব তহবিলে মোট সোনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ দশমিক ২ টন।

শিল্প খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেটালস ফোকাস বলছে, ভারতের গয়নার চাহিদায় যে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে, তা ২০২৬ সাল পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাদের পূর্বাভাস, পুরো বছরের হিসাবে গয়নার ব্যবহার আরও ৯ শতাংশ কমতে পারে। সোনার দাম ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় গয়না ব্যবহারে কাঠামোগত পরিবর্তন আসছে। ক্রেতারা এখন কম ক্যারেট ও হালকা ওজনের নকশার দিকে ঝুঁকছেন।

ডিপি অভূষণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান সন্তোষ কাটারিয়ার মতে, ১৮ ক্যারেট ও ১৪ ক্যারেটসহ কম ক্যারেটের গয়না এখন বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, বিশেষ করে তরুণ ক্রেতা ও কর্মজীবীদের মধ্যে। তাঁর ভাষায়, এ ধরনের গয়নায় ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে, আবার স্টাইলও বজায় রাখা যায়।

অর্থসূচক

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.