নানা জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই প্রত্যাবর্তন দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অনেকটা অবসান ঘটাবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাবে বলে মনে করছেন দেশের মানুষের একটি বড় অংশ। পুঁজিবাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থসূচককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন।
অর্থসূচক: আমাদের পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?
মিনহাজ মান্নান: আমাদের পুঁজিবাজারের অবস্থা যে ভাল যাচ্ছে না, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতসহ বিভিন্ন খাতে যে অবাধ লুণ্ঠন হয়েছে, সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে-তার মাশুল দিচ্ছে বাজার। এখানে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে পড়া, ব্যবসায় ধুঁকতে থাকা মন্দ কোম্পানিকে লাভজনক দেখিয়ে বাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রশ্রয়ে উচ্চ প্রিমিয়ামে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে বিপুল টাকা তুইলে নিয়েছে কিছু অসাধু উদ্যোক্তা। মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা নিয়ে অনেক সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নয়ছয় করেছে। বাজারে এসবের প্রভাব রয়েছে। এর সঙ্গে কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ছিল প্রবল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, তীব্র নিরাপত্তাহীনতা, বিশৃঙ্খলা। বাজারে এসবেরও প্রভাব ছিল অনেক। এসব কারণে আওয়ামীলীগ সরকারের বিদায়ের পরও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে মন্দের ভাল যে, গত দেড় বছরে বাজারে বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও মন্দ কোনো আইপিও আসেনি। এসময়ে আইনকানুন সংস্কারের বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো আগামী দিনে সুফল দিতে পারে।
অর্থসূচক: আপনি যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বললেন, বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা অনেকটাই কেটে গেছে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করছে। পুঁজিবাজারে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে কি মনে করেন?
মিনহাজ মান্নান: অবশ্যই পুঁজিবাজারে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, মাঝখানে তা অনেকটা পথ হারাতে বসেছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, মব সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্রের আভাস পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছিল। এতে আগামী নির্বাচনকে নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছিল। আদৌ ঘোষিত সময়ে নির্বাচনটি হবে কি-না, হলে সেটি শান্তিপূর্ণ হবে কি-না, সুনির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো দল সরকার গঠন করতে পারবে কিনা ইত্যাদি বিষয় সৃষ্ট উদ্বেগ অর্থনীতি ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। পুঁজিবাজারও এর বাইরে ছিল না। তারেক রহমানের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে এসব অনিশ্চয়তা প্রায় কেটে গেছে। তার প্রত্যাবর্তন কোনো সাধারণ প্রত্যাবর্তন নয়, রাজসিক প্রত্যাবর্তন। তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিনে তার সমাবেশে মানুষের যে ঢল নেমেছিল, তা দেশের ইতিহাসে বিরল। এটি তাঁর প্রতি দেশের মানুষের সমর্থন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। দেশকে এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্য থেকে বের করে আনতে হলে তার মত একজন নেতার নেতৃত্ব ও হাল ধরার বিষয়টি যে জরুরি, সেটি কেবল দেশের মানুষ নয়, বন্ধু ও শুভাকাঙ্খি রাষ্ট্রগুলোও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। তারেক রহমানের প্রতি তাদেরও সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে জনগণের আস্থা বেড়েছে। এই আস্থা পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির অচলাবস্থার অবসান ঘটাবে। বাজারে আমরা অকারণে আর কোনো বড় পতন দেখবো না আশা করি। বরং সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে আবার বাজারমুখী হবে।
সামগ্রিক অবস্থায় এটাও মোটামুটি পরিস্কার যে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার গঠন করবে। তারেক রহমান দৃঢ়ভাবে সরকারের হাল ধরবেন। তাতে দেশে সব ধরনের অস্থিতিশীলতার অবসান ঘটবে। অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার পুনরুজ্জীবনের নতুন শক্তি পাবে।
অর্থসূচক: অভিযোগ আছে যে, অতীতের সরকারগুলো দেশের পুঁজিবাজারকে প্রকৃতভাবে ধারণ করেনি। তাই এই বাজারের উন্নয়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আগামী সরকার যে এই বাজারকে জোরালোভাবে ওন করবে, সে বিষয়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?
মিনহাজ মান্নান: আমরা খুবই আশাবাদী। আপনারা দেখেছেন, গত দেড় বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন পুঁজিবাজার নিয়ে একাধিক সেমিনার-গোলটেবিল ও আলোচনার আয়োজন করেছে। সেখানে বিভিন্ন রাজৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও ছিলেন। তিনি আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে একাধিকবার এসব প্রোগ্রামে এসেছেন। সেখানে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, যদি বিএনপি সরকার গঠনে সক্ষম হয়, তাহলে তারা পুঁজিবাজারকে শতভাগ ওন করে এই বাজারের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবেন। তিনি দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারে প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়টি অনুধাবন করেন। নিজেও পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে এই বাজারের সমস্যা, সম্ভাবনা, বাজারের ডাইনামিক-সবই তাঁর নখদর্পণে। তাই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তিনি খুবই মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারবেন।
আমরা বিএনপি’র আগের মেয়াদের সরকারগুলোর সময়েও দেখেছি, তারা পুঁজিবাজারের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। ওই সময়ে বাজারে একটিও বড় কেলেঙ্কারি ঘটেনি, সংঘবদ্ধ লুটতরাজের ঘটনা ঘটেনি। আগামী সরকার কাছে আগের চেয়েও ভাল ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবেন বলে আশা করছি। কারণ তারেক রহমানসহ অন্যান্য নেতারা এখন আরও পরিণত, তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ।
অর্থসূচক: আগামী দিনে পুঁজিবাজার নিয়ে তাহলে আপনি অনেক আশাবাদী..
মিনহাজ মান্নান: অবশ্যই। এর অনেক কারণও আছে। শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান, স্থিতিশীলতা ও বিএনপির দৃঢ় নেতৃত্ব নয়, আরও অনেক ফ্যাক্টর পুঁজিবাজারের সম্ভাবনাকে জোরালো করে তুলছে। বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং খাতের যে নাজুক অবস্থা তার পেছনে যে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের অনুপস্থিতি তা বিভিন্ন নীতিনির্ধারকই উপলব্ধি করছেন। এমনকি দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর নির্বাহীরা পর্যন্ত এখন প্রকাশ্যে বিষয়টি স্বীকার করছেন। তাই ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থেই আগামীতে সবাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সমন্বিতভাবে কাজ ও সহযোগিতা করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
তাছাড়া পুঁজিবাজার ও অর্থনীতিতে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি কী অনিবার্য পরিণতি ডেকে আনে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামীলীগ সরকারের পতনে সেটি স্পষ্ট। এই শিক্ষাও আগামী সরকারকে পুঁজিবাজারের প্রতি যত্নশীল থাকতে উদ্বুদ্ধ করবে।
আগামী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো। এর জন্য যে বিশাল অর্থায়নের প্রয়োজন তা নাজুক ব্যাংকিং খাত সরবরাহ করতে পারবে না। অর্থনীতিকে সচল করার প্রয়োজনেই পুঁজিবাজারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.