গণমাধ্যম ও ছায়ানটে হামলার মতো ভয়ংকর ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের পর আর হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে হামলার সময় সরকারের নীরবতা ছিল বিস্ময়কর।
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের বিচার, সংবাদমাধ্যম, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ফিরোজ আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখতার, আইনজীবী মানজুর আল মতিনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যেভাবে গণমাধ্যম ও ছায়ানট একের পর এক আক্রান্ত হয়েছে, হামলার ঘটনা ঘটেছে, এ রকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধের পর আর হয়নি। এটা আমাদের চিন্তার মধ্যে ছিল না যে একটা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পর, একটা গণ–অভ্যুত্থানের পর এ রকম একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে।’
সংবাদমাধ্যমের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে সরকার বলে যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে এবং কে যে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। গণমাধ্যম, ছায়ানট ও উদীচীর ওপর হামলা কোনো আকস্মিক ঘটনা না। কারণ, বহুদিন ধরে এ নামগুলো উচ্চারিত হচ্ছে।
হামলাকারীরা যে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, সেটা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজানা থাকার কথা নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা কেন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, সরকার কেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি, এ প্রশ্ন করা দরকার। এসব হামলার সময় সরকারের নীরবতা ছিল বিস্ময়কর।
এসব প্রতিষ্ঠানে যখন আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সরকার সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনাকারীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছে কি না, এ প্রশ্ন তোলেন তিনি।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘তারা কি চায় এ আক্রমণগুলো হোক? তারা কি চায় এ দেশে একটা আতঙ্ক তৈরি হোক? দেশের মধ্যে সৃজনশীলতা, সাংস্কৃতিক তৎপরতা, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যত রকম চেষ্টা, সেগুলো কোণঠাসা হোক বা পরাজিত হোক? একটা নতুন স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হোক?’
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরের ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দালাল বলে নূরুল কবীরের ওপর হামলা হলো। অথচ আমরা জানি, নূরুল কবীর শুধু দেড় দশক ধরে নয়, আশির দশক থেকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন, লেখালেখি করেছেন, আন্দোলন করেছেন।’
বর্তমান সময়ে অন্যায়, অবিচার কিংবা বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁদেরকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে আক্রমণ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সরকারের আগে নাগরিকদের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তথ্য প্রকাশ হয়েছে। হাদির ওপর হামলার পরমুহূর্ত থেকে এ তথ্য আসার পরও খুনি কীভাবে দেশ থেকে পালাল? সরকার হাদির হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক কথা বললেও হত্যাকারীকে ধরার ব্যাপারে তাদের সক্রিয়তা ছিল না।
আগের সরকারের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আগেও দেখেছি, কিছু কিছু হত্যাকাণ্ড—ত্বকী বলেন, সাগর–রুনি বলেন, তনু বলেন—সরকার কীভাবে নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে কিংবা নানা ধরনের ছলচাতুরি দিয়ে বিচারের মধ্যে প্রবেশ করতে চায়নি। তারা হত্যাকারীকে সামনে আনতে চায়নি। এ সরকারের সময়ও আমরা একই ধরনের ঘটনা দেখতে পাচ্ছি।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যেসব হামলা হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ হচ্ছে, হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সরকারের হত্যাকারী বা আক্রমণকারীকে ধরার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তিনটি জায়গায় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এখানে সংবাদমাধ্যমগুলোর একটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে আসা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর এই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পক্ষে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দরকার। আর নাগরিকদের মধ্য থেকে যত ধরনের সংগঠন আছে, সবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হওয়া উচিত।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের একটা অংশ পাঠ করেন আইনজীবী মানজুর আল মতিন। দ্বিতীয় অংশ পাঠ করেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ফিরোজ আহমদ ও দাবিগুলো পড়ে শোনান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ৬টি দাবি উত্থাপন করা হয়। সেগুলো হলো ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ তদন্ত ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার; গণমাধ্যম, ছায়ানট, নালন্দা বিদ্যালয়, ধানমন্ডি–৩২–এ হামলাসহ ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু চন্দ্র দাশের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচার; নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ; দেশ ও দেশের বাইরে থেকে উসকানিদাতাদের শাস্তির আওতায় আনা এবং ওসমান হাদির জানাজার পর অস্থিতিশীলতা যেন তৈরি না হয়, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘গণমাধ্যমের সঙ্গে আমার অনেক দ্বিমত রয়েছে। আমি যা চাই, তা থেকে ভিন্নভাবে কিছু বলেছে, সেটার জন্য পত্রিকা বন্ধ করে দিতে হবে, সেটা আমি কখনো সমর্থন করি না। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গণমাধ্যমের নন, আমরা যাঁরা ওই রাতে গিয়েছিলাম তাদের রক্ষা করতে, আমরা গণমাধ্যমের কেউ নই। তারপরও আমরা গিয়েছিলাম। কারণ, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ আমরা করতে চেয়েছি।’
শহিদুল আলম বলেন, ‘যে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি, সে হাসিনার চরিত্র নিজেরা নিতে যাচ্ছি, এটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক, আপত্তিজনক ও বিপজ্জনক।’
১৮ ডিসেম্বর রাত থেকে যা হচ্ছে বাংলাদেশে, তা উদ্বিগ্ন করছে বলে উল্লেখ করেন গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখতার। তিনি বলেন, ‘শুধু উদ্বিগ্ন নয়, আমরা আসলে কোন বাংলাদেশ চেয়েছি, অভ্যুত্থানের পর সেটা নিয়েও আমাদের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’
গণমাধ্যম, ছায়ানট ও উদীচীর ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখ করে তাসলিমা আখতার বলেন, ওসমান হাদি বেঁচে থাকলে এ ধরনের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন। সারা দেশে একটার পর একটা হামলা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি যাতে ফিরে না আসে, নির্বাচন যাতে বাধাগ্রস্ত হয়, সেটারই একটা চেষ্টা বলে মনে হয়।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ‘দেশ–বিদেশে অভিযোগ দেওয়ার পর দুই ব্যক্তির মধ্যে অন্তত একজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে মেটা। আমরা একদম যে হতাশ, তা নই।’
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.