ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অশুভ লেনদেন কিংবা আঁতাতের সংস্কৃতি গড়ে উঠলে শুধু প্রশাসনিক সংস্কার দিয়ে সমাধান হবে না। অবৈধ আয়ের রাজনৈতিক চাহিদা যদি থাকে, তাহলে শুধু বিধিবিধান দিয়ে তার পথ বন্ধ করা যাবে না। একটি উৎস বন্ধ করলে আরেকটি উৎস চালু হবে। অতীতে তাই দেখা গেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে এমন মত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে দুই দিনের সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিও ছিলেন তিনি। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য– গণতন্ত্র ও উন্নয়ন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-পরবর্তী অবস্থায় অন্তত তিনটি বিষয় খুব প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, কার্যকর গণপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সর্বশেষ হলো, উন্নয়নের গুণগত মান বাড়ানো অর্থাৎ যে উন্নয়ন ন্যায্য এবং বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হবে। এই তিন বিষয় নিয়ে আলাদা করে গবেষণা করা যায়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, এখনকার সব আলাপ-আলোচনা কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভারতের মতো দেশেও ঘুষ নেওয়ার মতো দেওয়াও অপরাধ। বাংলাদেশে ঘুষ দেওয়াকে সেভাবে অপরাধ মনে করা হয় না। কোনো অবৈধ সুবিধা আদায় যেমন কর ফাঁকির জন্য ঘুষ দেওয়া হলে ঘুষদাতা তা বলবেন না। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সাধারণ করদাতাদের হয়রানি বন্ধ হবে। তবে বড় কর ফাঁকি এর মাধ্যমে সমাধান হবে না। এটি আরও বড় সংস্কারের বিষয়। আইনবিধি দিয়ে যার সমাধান হবে না। তিনি মনে করেন, প্রশাসনসহ সব স্তরে জবাবদিহিই মূল বিষয়। এর সঙ্গে দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। দায়িত্ববোধের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এখনকার প্রাথমিক শিক্ষকরা ছাত্রদের পরীক্ষা বন্ধ করে ও তাদের জিম্মি করে আন্দোলন করছেন। অথচ তাদের সময় শিক্ষকরা বাসায় এসে পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে উপদেষ্টা বলেন, অতীতে উপদেষ্টার দায়িত্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতেই এবার উপদেষ্টা হতে রাজি হন তিনি। তবে প্রশাসনযন্ত্র এখন যেভাবে চলে, তাতে আগের চেয়ে এবারের অভিজ্ঞতা খারাপ।
গণতন্ত্রের মান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন কিংবা জুলাই সনদ– সবই একটা কার্যকর গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পরও এগুলো এ মুহূর্তের একটা সীমিত লক্ষ্য। একটা কার্যকর বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এতদিন পরে এসেও সীমিত করে ভাবতে হচ্ছে, যা দুঃখজনক। তবু নতুন স্বপ্ন হয়তো দেরিতে হলেও টেকসই বন্দোবস্তের দিকে এগিয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রধানত বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে। যেখানে রাষ্ট্রেরও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এর মধ্যেই আবার ন্যায্য ও বৈষম্যহীন সমাজ চাই। এটি কীভাবে হবে তা নির্ভর করে একটা দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ওপর। এর একক কোনো সমাধান নেই। কোনো দেশ থেকে ধার করে আনার বিষয় নয়।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সংস্কারের ভাবনা হলো– কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য একটা নির্বাচিত সংসদ থাকবে, যারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এর সঙ্গে স্বাধীন বিচার বিভাগ, দুর্নীতি কমিশন, নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম কার্যকর জবাবদিহির জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্বশর্ত। তবে বাস্তবে গণতন্ত্রের গুণগত মান নির্ভর করবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আচার-আচরণের ওপর। এটি এক দিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়।
তিনি বলেন, জনকল্যাণমুখী না হয়ে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বিতরণ যদি রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়, তাতে যুব সমাজের একটা বড় অংশ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিকেই জীবিকার উপায় বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। টেন্ডার ও চাঁদাবাজি এরই অংশ। এর অংশ হিসেবে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুধু ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করে না, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণকে তাদের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসে। শিক্ষার নিম্ন মান এবং বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও তার সঙ্গে বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক ক্যাডারভিত্তিক ঝোঁক– এগুলো পারস্পরিক সম্পর্কিত। পৃথকভাবে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু রাজনীতিকে দোষারোপ করলে হবে না।
ব্যবসার পরিবেশ সম্পর্কে উপদেষ্টা বলেন, যদি প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে হবে ও ব্যবসায় বিনিয়োগ পরিবেশের অনুকূল পরিবেশ কীভাবে হবে– তা নিয়ে ভাবতে হবে। এগুলোর বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন হলে সংকটের সমাধানে তা সহায়ক হবে। তবে কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনেই সমাধান আসবে না। সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয় অর্থায়ন কীভাবে হবে, আয়ের পুনর্বণ্টনে কর ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত এবং বাজার ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক যাতে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ তৈরি না করে এবং মুনাফাতাড়িত ব্যবসাকে কীভাবে সামাজিক কল্যাণের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়– এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকজন বড় শিল্পপতি যাতে পুরো নীতিনির্ধারণের বিষয়গুলো করায়ত্ত করতে না পারে– তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি জানান, এসবের প্রাসঙ্গিক আলোচনা তাঁর রচিত দুটি বইয়ের মধ্যে আছে। তবে মুশকিল হলো– এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে গেলে তাঁর দলনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। বর্তমান ট্যাগিংয়ের সময় যা খুব বিপজ্জনক।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, কোনো দেশই এত দরিদ্র নয় যে, সব নাগরিকের ন্যূনতম জীবিকার চাহিদা মিটাতে পারে না। প্রয়োজন উপযুক্ত অর্থনৈতিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থের সমন্বয় বা ভারসাম্য রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.