সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনারা সম্প্রতি একটা বড় ভূমিকম্প দেখেছেন। এটা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। কিন্তু এরচেয়ে বড় ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে। সেটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকম্প।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ‘অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেছেন। রাজধানীর পুরানাপল্টনে ইআরএফ মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক ও ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি শামসুল হক জাহিদ, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক সচিব, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ও শিশুসাহিত্যিক ফারুক হোসেন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল অর্থসূচক এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বইটি প্রকাশ করেছে চন্দ্রাবতী একাডেমি। এটি সম্পাদনা করেছেন অর্থসূচকের সম্পাদক জিয়াউর রহমান।
ব্যাংকখাতের লুকানো সব সংকট সামনে আসছে
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ব্যাংকখাতের গোপন খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, পুঁজি ঘাটতি- সব সংকট একে একে সামনে আসছে। বিনিয়োগ স্থবির, নীতিগত স্বচ্ছতা কম এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার না থাকায় অর্থনীতি চাপে রয়েছে। (ব্যাংকের) শরীরে যে এত রোগ তা আগে জানা-ই যায়নি।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, দীর্ঘদিন ঢেকে রাখা খেলাপি ঋণের পাহাড়, প্রভিশনের গর্ত আর তারল্য সংকট- সব অসুখ এখন একে একে প্রকাশ্যে। এই বাস্তবতা তুলে ধরে দেশের নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও সংস্কারহীনতার সমালোচনা করেন তিনি। একসঙ্গে ধরা পড়া এসব দুর্বলতা বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। তার অভিযোগ, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া হঠাৎ বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণা ও নীতিগত অস্পষ্টতা বিনিয়োগ পরিবেশ আরও দুর্বল করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করছে। একই সঙ্গে সংস্কার ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনা স্বপ্নের মতো বলেও জানান তিনি।
ড. দেবপ্রিয় ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সমাধানে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
তিনি বলেন, পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করা, প্রশাসক নিয়োগ বা কিছু নিয়ম আগের অবস্থায় ফেরানো- এসবের বাইরে সুশাসন নিশ্চিত করতে কী করা হয়েছে?
বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশ অত্যন্ত দুর্বল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বহু বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুদের হারসহ নীতিগত দিকনির্দেশনাও এখনো পরিষ্কার নয়।
সংস্কার নিয়ে হতাশা
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম সরকার সংস্কার ইস্যুতে রিলেরেসের মত করে দৌড়াবে। আমরা দেখছি তারা দৌড়াতে দৌড়াতে লাঠিটা ফেলে দিয়েছেন। এখন লাঠি ছাড়াই দৌড়াচ্ছেন।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বন্দর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন জরুরি- এ কথা উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণায় তাড়াহুড়োর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মিডিয়া সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, শ্বেতপত্র অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদিতে কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু মাত্র ১৩ দিনে বিশাল বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন ও চুক্তি করতে পেরেছে। এটা ইঙ্গিত করে, সরকারের সামর্থ্যের ঘাটতি নেই। চাইলে সংস্কারগুলোও একইভাবে এগিয়ে নিতে পারতো।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক ও ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি শামসুল হক জাহিদ বলেন, বাংলাদেশে এক সময় অর্থনৈতিক প্রতিবেদন বলতে কেবল বাজেটের আগে ও পরে কয়েকটা প্রতিবেদন হত। প্রায় তিন দশক আগে প্রয়াত মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আমরা কয়েকজন ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) গঠনের উদ্যোগ নিই। ইআরএফের উদ্যোগে নানামুখী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হতে থাকে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের দক্ষতার উন্নয়নে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজার ৫০ শতাংশ ডাউন হয়েছে। এই বাজার অনাথের মতো। দেখার কেউ নেই।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার ইস্যুতে সরকার যা কিছু উদ্যোগ নেয়, সেগুলো গণমাধ্যমে রিপোর্টের কারণে অনেকটা চাপে পড়েই নেয়। তিনি ইসলামীধারার ৫টি ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, সরকার বলছে, পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করা হয়েছে। আসলে তা একীভূতকরণ নয়, এগুলোকে বেইলআউট করা হয়েছে। এভাবে একীভূতকরণ হয় না। এমন সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক তো আরও রয়েছে, সেগুলোর কী হবে?

বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা কিছুটা উপেক্ষিত। দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাংবাদিকতা বিভাগ আছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা পড়ানো হয়।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.