রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের অবসান করতে যুক্তরাষ্ট্র যে বিতর্কিত ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছে, তাতে যুক্ত করা নতুন পরিবর্তনসমূহকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের ইউরোপীয়ান মিত্ররা রাশিয়ার যুদ্ধের পক্ষে থাকা অংশগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার পরে শান্তি পরিকল্পনার একটি সংশোধিত সংস্করণ করা হয়েছে।
টেলিগ্রামে জেলেনস্কি বলেন, এখন যুদ্ধ শেষ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হতে পারে…। অনেক সঠিক উপাদান এখন এ কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে, কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটস্কো বলেন, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় রাজধানীর একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।
ইউক্রেনের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও দেশটির জ্বালানি অবকাঠামোগুলোতে ব্যাপক ও সম্মিলিত হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই জ্বালানি কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ এবং পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু করবেন।
রোববার জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের কর্মকর্তারা শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক করেন যেটি কিয়েভ এবং তাদের ইউরোপীয়ান মিত্রদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি। এর আগে অক্টোবরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কর্মকর্তারা এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
সোমবার ক্রেমলিনের এক কর্মকর্তা শান্তি পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোকে ‘সম্পূর্ণ অগঠনমূলক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্যদিকে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জোরালো দাবি করেছেন যে, যুদ্ধ অবসানের প্রচেষ্টায় ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে না।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা এই যুদ্ধে কোনো পক্ষের সঙ্গে সমানভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে না— এমন ধারণা সম্পূর্ণ এবং পুরোপুরি ভুল। লিভিট আরও বলেন, এই যুদ্ধ অবসানে কাজ করতে পারে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরির বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আশাবাদী’ ছিলেন।
জেনেভায় আলোচনা শেষ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ভালো কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু তিনি এটাও বলেছেন যে, যতক্ষণ না আপনি তা নিজে দেখতে পান, ততক্ষণ কিছু বিশ্বাস করবেন না।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২৮ দফার শান্তি পরিকল্পনা ক্রেমলিনের পরামর্শে বা সম্পূর্ণ তাদেরই মনমতো বানানো হয়েছে— এমন অভিযোগ অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই জেনেভার আলোচনা শুরু হয়। কারণ এর বেশ কয়েকটি উপাদান মস্কোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বলে মনে করা হয়েছিল।
স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় জেলেনস্কি বলেন, সংশোধিত পরিকল্পনাটি ছিল সত্যিই সঠিক উপায়। তিনি আরও বলেন, সংবেদনশীল বিষয়গুলো— সবচেয়ে নাজুক বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করব। তবে কবে বা কখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন তা তিনি উল্লেখ করেননি।
জেলেনস্কির কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুক্রবার ফাঁস হওয়া ২৮ দফা পরিকল্পনাটি আর বিদ্যমান নেই। সপ্তাহের শেষে জেনেভায় অংশ নেওয়া ইউক্রেনের ফার্স্ট ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার সের্গেই কিসলিৎসা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, সর্বশেষ পরিকল্পনায় মাত্র ১৯টি দফা রয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সংবেদনশীল কিছু বিষয়— যার মধ্যে আঞ্চলিক বা ভূখণ্ডগত ছাড়ের বিষয়টি রয়েছে— সেটি আলোচনার টেবিলে সমাধান না করে শীর্ষ নেতারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন সেজন্য রেখে দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার ঘোষণা দিয়েছেন, উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মঙ্গলবার ইউক্রেনের ইউরোপীয়ান মিত্রদের একটি ভার্চুয়াল ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনে একটি ‘ন্যায়সঙ্গত এবং স্থায়ী শান্তির’ জন্য এখনো কিছু কাজ বাকি আছে।
এদিকে মস্কোতে ক্রেমলিনের পররাষ্ট্র নীতির সহকারী ইউরি ইউশাকভ সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম দেখায় এ ইউরোপীয়ান পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে গঠনমূলক নয়, এবং এটি আমাদের জন্য উপকারী নয়।
সোমবার জেলেনস্কি বলেছিলেন, এখানে ‘প্রধান সমস্যা’ হলো রাশিয়া যেসব অঞ্চল দখল করে নিয়ে গেছে, সেগুলোর আইনি স্বীকৃতি দাবি করেছেন পুতিন।
ইউক্রেনকে ২৭ নভেম্বরের মধ্যে চুক্তি মেনে নেওয়া অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে— ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে শুক্রবার ইউরোপজুড়ে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একই সঙ্গে ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে তাড়াহুড়ো করেই আলোচনা শুরু হয়।
রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলোর কোনো স্বীকৃতি না দিয়েই যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি পাল্টা খসড়া প্রস্তাব করেছে। এতে ইউক্রেনের অনুমোদিত সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধি এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার দরজা খোলা রাখা হয়েছে।
দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল নিয়ে গঠিত পূর্ব ডনবাস থেকে ধারাবাহিক ও পুরোপুরি ইউক্রেনীয়দের প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। ক্রিমিয়া এবং আরও দুটি অঞ্চল— খেরসন এবং ঝাপোরিঝঝিয়ার বিশাল অংশও নিয়ন্ত্রণ করে পূর্ব ডনবাস। জেনেভা আলোচনায় মার্কিন খসড়া প্রস্তাবের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাপকভাবে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই শান্তি পরিকল্পনায় বর্তমানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। দোনেৎস্কের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী লুহানস্ক অঞ্চল এবং ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপে কার্যত নিয়ন্ত্রণ থাকবে রাশিয়ার।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা খেরসন এবং ঝাপোরিঝঝিয়ার সীমান্ত বর্তমান যুদ্ধরেখা বরাবর স্থির করে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে এই পরিকল্পনায়। আংশিকভাবে উভয় অঞ্চলই রাশিয়ার দখলে। প্রতিবেশী পোল্যান্ডে ইউরোপীয়ান যুদ্ধবিমানগুলো মোতায়েন রাখার কথাও বলা হয়েছে মার্কিন এই পরিকল্পনায়।
একই সঙ্গে মার্কিন এই পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সংখ্যা ছয় লাখে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন সেখানে সৈন্য সংখ্যা আট লাখ ৮০ হাজার জন। এই খসড়াতে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ না চাওয়ার অঙ্গীকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
প্রায় চার বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে লাখো সেন্য এবং হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত বা আহত হয়েছেন। এছাড়া লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.