বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় পুড়িয়ে ফেলা শহীদদের জন্য কিছু করতে না পারায় তাদের পরিবারসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন রাজসাক্ষী পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শেখ আবজালুল হক। একইসঙ্গে তিনি জানান, ওই বছরের ১৫ আগস্ট নিজের ইস্যু করা অস্ত্র জমা দিতে এসে জানতে পারেন আশুলিয়া থানার তৎকালীন ওসি সায়েদ ও এএসআই বিশ্বজিৎ মিলে ছয়টি মরদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছেন।
আশুলিয়ায় ছয় মরদেহ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে বুধবার (১৯ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য বিচারপতি মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
আবজালুল হক এ মামলায় ২৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। এ সময় তিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া ঘটনার পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন। যদিও মরদেহ পোড়ানোর সময় তিনি ছিলেন না বলে জানান। তবে ১৫ আগস্ট নিজের ইস্যু করা অস্ত্র জমা দিতে এসে জানতে পারেন লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার কথা। আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সায়েদ ও পরিদর্শক (এএসআই) বিশ্বজিৎ মিলে ছয়টি মরদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেন বলে জানান তিনি। সবশেষ তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান।
এর আগে গত ২ জুলাই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে অন্যান্য তথ্যসূত্র হিসেবে ৩১৩ পৃষ্ঠা, সাক্ষী ৬২, দালিলিক প্রমাণাদি ১৬৮ পৃষ্ঠা ও দুটি পেনড্রাইভ যুক্ত করা হয়। পরে এ মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ২১ আগস্ট এ মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ওই সময় উপস্থিত আট আসামির সাতজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তবে দোষ স্বীকার করেন এসআই শেখ আবজালুল হক। একইসঙ্গে রাজসাক্ষী হতে চেয়ে মামলার ব্যাপারে যা জানেন সব আদালতের কাছে বলতে চান। পরে তার দোষ স্বীকারের অংশটুকু রেকর্ড করা হয়। একইসঙ্গে লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজসাক্ষী হওয়ার অনুমতি পান তিনি।
এ মামলায় গ্রেফতার আট আসামি হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনও পলাতক রয়েছেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম দিনের মতো সাক্ষ্য দেন শহীদ আস সাবুরের ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম ও শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের বাবা মো. খলিলুর রহমান। এর আগের দিন সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ার সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি।
গত ৩০ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন গুলিবিদ্ধ হওয়া ভুক্তভোগী সানি মৃধা। ২১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে পুলিশের গুলিতে নিজে আহত হওয়ার কথা জানান তিনি। একইসঙ্গে গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ার নির্মমতার দৃশ্যের বিবরণ দেন। ২৯ অক্টোবর জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আশুলিয়া থানার এসআই মো. আশরাফুল হাসান। তিনি একই থানার ওসির নির্দেশে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল রাইফেলের ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেন বলে জানিয়েছেন। পরে থানায় জমা দেন এ আলামত।
গত ৫ নভেম্বর ২২ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন প্রত্যক্ষদর্শী শাহরিয়ার হোসেন সজিব। তার সামনেই একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এমনকি তার বন্ধু সাজ্জাদ হোসেন সজলকেও আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। পরে তাকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
গত ১৮ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও বিশেষ পরিস্থিতির কারণে হয়নি। যদিও আসামিদের হাজির করা হয়। ১২ নভেম্বরও একই কারণে সাক্ষীকে হাজির করেনি প্রসিকিউশন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ছয় তরুণ। এরপর পুলিশ ভ্যানে তাদের লাশ তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নৃশংস এ ঘটনার সময় একজন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তাকেও বাঁচতে দেননি তারা। পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত মানুষকেই পুড়িয়ে মারা হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.