২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের রায় ঘোষণা করা হবে আজ। মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এটি হতে যাচ্ছে প্রথম রায়।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল ১১টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বহুল আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা করবে।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্টার অফিস জানিয়েছে, সকাল ১১টায় রায় উপলক্ষে আদালত বসবে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করবেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সরাসরি রায় ঘোষণা করবে। সেজন্য সারা দেশ এবং বিশ্বের নজর থাকবে প্রতিটি মুহূর্তে।
ঐতিহাসিক রায় আজ
গত ১৩ নভেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজকের দিনটি রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারণ করেন। মামলার পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আবেদন করেছে প্রোসিকিউশন। অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আসামিদের খালাস চেয়েছেন।
গত ২৩ অক্টোবর দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয় মামলাটি।
রায় সরাসরি সম্প্রচার
শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরাসরি সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চিফ প্রোসিকিউটর কার্যালয়। একইভাবে রায় ঘোষণার অংশও আজ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে গতকাল জানিয়েছেন প্রোসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।
সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সম্ভাবনা
প্রোসিকিউশন জানিয়েছে, আইন সংশোধনের ফলে দণ্ডের পাশাপাশি অপরাধের ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিতে আসামিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের বিধান সংযোজন করা হয়েছে। তাই রায়ে মৃত্যুদণ্ড চাইতে গিয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আবেদনও জানানো হয়েছে।
পলাতক থাকলে আপিল নয়
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান পলাতক থাকায় রায়ে দণ্ডিত হলে তাঁরা আপিল করতে পারবেন না- এ নিয়ম স্পষ্ট করেছেন প্রোসিকিউটর তামীম।
নারী আসামির জন্য বাড়তি সুবিধা নেই
শেখ হাসিনার নারী হওয়ায় কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান প্রসিকিউশন। রায় শুধুই অপরাধের ‘গ্র্যাভিটি’ বিবেচনায় হবে, ব্যক্তি পরিচয়ে নয়।
পাঁচটি অভিযোগে যেভাবে অভিযুক্ত তিন আসামি
১. উসকানি ও হত্যার নির্দেশনা (১৪ জুলাই)
চীন সফর শেষে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপে উৎসাহিত করার অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়।
২. হেলিকপ্টার–ড্রোন হামলার নির্দেশ
হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অধীনস্ত বাহিনীর মাধ্যমে এই নির্দেশ বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলেন দুই শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
৩. রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড
১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা ও পরে ময়নাতদন্তে হস্তক্ষেপ এবং সহপাঠীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগ প্রোসিকিউশনের অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
৪. চানখাঁরপুলে ছয় ছাত্রকে গুলি করে হত্যা (৫ আগস্ট)
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তিন আসামির।
৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে ফেলা
আশুলিয়ায় গুলিতে ছয়জন নিহত হন ৫ আগস্ট। পরে তাঁদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়- এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবেও শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়ার টাইমলাইন (সংক্ষেপে)
৫ আগস্ট, গত বছর: শেখ হাসিনা সরকারের পতন।
১৪ আগস্ট: তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রোসিকিউশনে মামলা দাখিল।
১৭ অক্টোবর: গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
২৫ মে–৮ অক্টোবর: আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর বিভিন্ন মামলার তদন্ত ও শুনানি।
৩ আগস্ট: বিচার শুরু।
২৮ কার্যদিবসে ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ।
২৩ অক্টোবর: যুক্তিতর্ক শেষ।
১৩ নভেম্বর: রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ।
আজ, ১৭ নভেম্বর: রায় ঘোষণা।
রায়ের অপেক্ষায় আরও দুই মামলা
জুলাই অভ্যুত্থান ছাড়া আগের শাসনামলের গুম, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে আরও দুটি মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। উভয় মামলার প্রধান আসামি শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
উচ্চ আদালত এলাকায় উত্তেজনা
গতকাল হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করেন। রায় ঘিরে সর্বস্তরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
আজকের রায়ই নির্ধারণ করবে- জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তিন শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন দৃষ্টান্তমূলক রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হতে যাচ্ছে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.