দেশের ৩৫৩ পোশাক কারখানা বন্ধ, সোয়া লাখ শ্রমিক বেকার : বিজিএমইএ

বাংলাদেশের গার্মেন্টসশিল্প অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা। কয়েক শ কারখানা বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছেন বলে তথ্য দিচ্ছেন তারা। তবে রপ্তানির পরিসংখ্যানে পরিস্থিতি ততটা খারাপ দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।

তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান ভিত্তি ও কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় উৎস।

খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাবে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এবং আরো প্রায় দুই কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিজিএমইএর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে সাভারে, যেখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, এর মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে এবং ৯২টি অস্থায়ীভাবে। প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন ও সাফওয়ান আউটারওয়্যারের মতো বড় কারখানাও রয়েছে।

গাজীপুরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন, যেখানে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আসলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একেবারে যে খুব খারাপ অবস্থায় চলে গেছি, বিষয়টি এমন না। তবে এই ১৪ মাসে আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে চীন ও ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে আমরা বেশ কিছু সুবিধা পেতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি। বিশেষ করে এক ধরনের অভিভাবকশূন্য অবস্থায় আমরা আছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমরা বারবার চিঠি দিয়েছি, কিন্তু সেখান থেকে কোনো সদুত্তর বা দেখা করার সুযোগ পাইনি।’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেছেন, কয়েক দিন আগেও প্রধান উপদেষ্টার সামনে তিনি বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব একটি দায়িত্বশীল পদ। তিনি আমার কথা না বুঝে যেটা বলেছেন, সেটা ঠিক হয়নি। আমি বলেছি, নবনির্বাচিত বিজিএমইএর কমিটি নিয়ে দেখা করার সুযোগ চেয়েও পাইনি। উনি উল্টোটা বুঝেছেন।’

এদিকে কিছু কারখানা বন্ধ হওয়াকে খারাপ কিছু নয় বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। কয়েক দিন আগে তিনি বলেছেন, ‘নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা বন্ধ হওয়া খারাপ কিছু নয়। এটি শিল্পের সুষ্ঠু ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।’

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি সত্যি কথা বলি, তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরা ভালো নেই। নির্বাচিত সরকারের দিকে চেয়ে বসে আছে বায়াররা। ছোট ফ্যাক্টরিগুলো টিকতে পারছে না। তারা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে আরেক বিপদ তৈরি করেছে। আসলে এখানে আমাদের কোনো অভিভাবক নেই। এতিমের মতো টিকে আছে সেক্টরটি।’

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তো শ্রমিকরাও অংশ নিয়েছিলেন। বৈষম্য নিরসনের যে দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, সেটা নিরসন হয়নি। উল্টো কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শ্রমিকেরা যে কাতারে ছিলেন সেই কাতারেই রয়ে গেছেন। যারা বেকার হয়েছেন তাদের সংসার কোনোভাবেই চলছে না। নতুন কিছু গার্মেন্টস হলেও সেখানে তো সবার কর্মসংস্থান হচ্ছে না।’

পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। সাম্প্রতিক এই সংকট শুধু শিল্প মালিকদের নয়, বরং সার্বিক অর্থনীতির ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার বাজারে মন্দা, চাহিদা কম এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে রপ্তানি কমছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না। এখন নির্বাচিত সরকার এলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী নতুন অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাই মাসে দেশের সার্বিক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছিল। এরপর টানা তিনমাস ধরে নেতিবাচক ধারা চলছে। সবশেষ অক্টোবরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে সাত শতাংশেরও বেশি। এতে দেখা যায়, রপ্তানি কম হয়েছে ৫১ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকার মতো। গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি হয় ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য। এবছরের অক্টোবরে তা ৩৬২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাবে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি বছরের হিসাবে তা আরো বেশি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, মালিকরা যতটা খারাপ বলছেন পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গার্মেন্টস মালিকরা যা বলছেন তার সঙ্গে কিন্তু রপ্তানি সূচক মিলছে না। মালিকরা বলছেন, গার্মেন্টস বন্ধ হচ্ছে, অর্ডার নেই, শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের রপ্তানি সূচক দুই অংকের ঘরেই রয়েছে। শুধুমাত্র গত মাসে এক অংকে নেমেছে। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি আগের মতোই রয়েছে। হতে পারে বড় কারখানাগুলো থেকে রপ্তানি বেশি হচ্ছে, ছোট কারখানাগুলো হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আসলে নির্বাচিত সরকার ছাড়া সঠিক বিনিয়োগ হয় না।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু কিছু সংশোধনী নিয়ে নাখোশ মালিকেরা।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘একতরফাভাবে সংশোধিত শ্রম আইন শিল্পে অস্থিরতা বাড়াবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমাবে, রপ্তানি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও দেশের অর্থনীতি দুর্বল করে তুলবে। নতুন আইনে শিল্প মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়নি।’

শ্রম সংশোধন অধ্যাদেশকে ‘ভারসাম্যহীন’ ও ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদে একতরফাভাবে শ্রম আইন সংশোধন করে মাত্র ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান করা হয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ মাত্র ২০ জন শ্রমিক দিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হলে কারখানাগুলোতে এমন ব্যক্তিরা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন, যারা শিল্পসংশ্লিষ্ট নন। এটি অন্তর্দ্বন্দ্ব ও শিল্পে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে এবং উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হবেন।’

শ্রম অধ্যাদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, শিল্প, শ্রমিক ও অর্থনীতির বাস্তব চাহিদা বিবেচনায় নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে৷ আইন যেন শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা নষ্ট না করে; বরং টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন করে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে দুই থেকে তিন লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। এই সরকারের সময়েও চারজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন তারা ট্রেড ইউনিয়নও বন্ধ করতে চায়, যা কোনভাবেই প্রত্যাশিত না। বরং এই সরকারের সময় আমরা দেখেছি, বেতন-ভাতার আন্দোলনে যাওয়া শ্রমিককে গুলি করা হয়েছে। কোনো সুযোগ-সুবিধা তো বাড়েইনি, দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে শ্রমিকদের অবস্থা।’

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.