এলডিসি উত্তরণ ৬ বছর পেছাতে চায় বাংলাদেশ

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে সংকট তৈরি হবে। এমন উদ্বেগ জানিয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণ ২০২৬ সাল থেকে পিছিয়ে ২০৩২ সালে নির্ধারণের দাবি করে সরকারের কাছে সম্প্রতি চিঠি দেয় শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠনগুলো। ব্যবসায়ীদের এ উদ্বেগ জাতিসংঘকে জানিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে জাতিসংঘকে বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন মূল্যায়নের অনুরোধ করা হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দিতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয়নি।

সরকারের এ অনুরোধে সাড়া দিয়ে পর্যালোচনা করতে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। অর্থ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও হাই রিপ্রেজেনটেটিভ এবং পঞ্চম এলডিসি সম্মেলনের সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমার কাছে সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর স্বাধীন পর্যালোচনা করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জাতিসংঘের হাই রিপ্রেজেনটেটিভের কার্যালয়ের পরিচালক রোনাল্ড মোলেরুসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের আগামী ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে। প্রতিনিধি দলটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করবে। আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিনিধি দল একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরামর্শভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করবে।

গত ২৪ আগস্ট ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, আইসিসি বাংলাদেশসহ ১৬ ব্যবসায়ী সংগঠন একযোগে সংবাদ সম্মেলন করে এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করে। পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সরকারের জরুরি উদ্যোগ চায় এসব সংগঠন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার জাতিসংঘকে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।

২০১৮ সালে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এই তিন সূচকে উত্তীর্ণ হয়ে জাতিসংঘের মানদণ্ডে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর ২০২১ সালে আরেকবার পর্যালোচনা করা হয়। ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ যেসব সমস্যায় পড়বে তা উল্লেখ করে ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করবে। তারা বেসরকারি খাতসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করবে। তারপর বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা জানাবে। সচিব আরও বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এর আগে ভূটানের উত্তরণ জাতিসংঘ নিজেই পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশের বিষয়টিও তাদের ওপর নির্ভর করছে।

ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। ওষুধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বড় বড় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। ফলে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে।

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান (বাবু) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণ সফল ও টেকসই করতে প্রস্তুতির জন্য বাড়তি সময় প্রয়োজন। আমরা চাই ২০২৯ সালে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। পরবর্তী তিন বছর হোক রূপান্তরের সময়। সব মিলিয়ে আমরা ছয় বছর পেছানোর কথা বলছি।’

বিজিএমইএ সভাপতি জাতিসংঘের স্বাধীন মূল্যায়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি খুবই ইতিবাচক দিক। কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণের মতো বড় সিদ্ধান্ত সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া যৌক্তিক। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসলে তারা তাদের উদ্বেগের দিকগুলো তুলে ধরবেন।

বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠাতে দেরি
গত ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন চেয়েছিল জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। তবে এ প্রতিবেদন প্রস্তুতিতে কিছুটা দেরি হওয়ায় তা পাঠাতে আরও সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন প্রস্তুতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি উত্তরণের পর আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ কোন কোন সমস্যায় পড়বে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নীতির ধারাবাহিকতা না থাকায় বাংলাদেশের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটার বিষয় প্রতিবেদনে থাকবে। শিগগির প্রতিবেদনটি পাঠানো হবে।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.