শিক্ষা কেবল বিদ্যায়তনের মধ্যে পাওয়া যায় না, জীবনের সব ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনের প্রাচীরবিহীন পরিসরের মধ্যে শিক্ষা লাভ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
এভাবে মুক্ত পরিসরের মধ্যে শিক্ষা লাভ করার মধ্য দিয়ে মানুষ যে সক্ষমতা অর্জন করে, সেটা তাকে স্বাধীনতা দেয়। এর মধ্য দিয়ে অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ শীর্ষক তত্ত্ব গড়ে ওঠে। যে শিক্ষা মানুষকে মুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা দেয়, সেটাই প্রকৃত শিক্ষা।
বিশিষ্ট দার্শনিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ৯২ তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত বাংলার পাঠশালার অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহান। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন নাট্যদল প্রাচ্যনাট স্কুলের একাডেমিক পরিচালক শহিদুল মামুন।
অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান বলেন, অমর্ত্য সেনের কাছে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি বহুমাত্রিক। চায়ের দোকান শুরু করে গাছতলা থেকেও শিক্ষা লাভ করা যায়। তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ক্যানটিন থেকে জীবনের বড় শিক্ষা লাভ করেছেন।
সেলিম জাহান বলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি যখন পড়তেন, তখন বলা হতো, অমর্ত্য সেনের মেধা জিলেট ব্লেডের মতো ধারালো। পরবর্তীকালে তিনি আরও অনেক মেধাবী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি পড়তে যান, তখন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান থেকে শুরু করে মনমোহন সিং, মাহবুবুল হক এমন আরও অনেক তীক্ষ্ণ মেধার মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক জ্ঞানকাণ্ড সমৃদ্ধ হয়েছে।
সেলিম জাহান মনে করেন শিক্ষার লাভের বিষয়টি কেবল জ্ঞানগত নয়, এর সঙ্গে দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিও জড়িত। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষকের জ্ঞানের দিক থেকে অত্যন্ত উঁচুতে সেটা আমরা দেখেছি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, কীভাবে শিক্ষাদান করতে হয়, সেই দক্ষতা না থাকায় তাঁরা যথাযথভাবে শিক্ষাদান করতে পারেন না। অর্থাৎ দক্ষতা না থাকলে জ্ঞানের প্রয়োগও যথাযথভাবে করা যায় না।
অমর্ত্য সেন সম্পর্কে সেলিম জাহান আরও বলেন, সেন একাধারে অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক। শেখার আগ্রহ তাঁর প্রবর। তিনি যখন কেমব্রিজে পড়তে যান, তখন গণিত জানতেন না বললেই চলে। তখন তিনি সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে স্নাতকদের ক্লাসের পেছনের দিকে বসে গণিত শিখতেন। এরপর এমন গণিত শিখলেন, যে কেমব্রিজে গণিত বিষয়ক সংগঠনের সভাপতি পর্যন্ত নির্বাচিত হন।
অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন বাংলার পাঠশালার সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ। তিনি অমর্ত্য সেনের শিক্ষা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘অমর্ত্য সেনের শিক্ষাচিন্তার মূলে রয়েছে “ফ্রিডম এন্ড রিজনিং” বা সক্ষমতা ও যুক্তিবিচারের গভীর অঙ্গীকার। এই মৌলিক বিষয়টি তিনি শান্তিনিকেতনের ব্যতিক্রমধর্মী বিদ্যাপীঠ থেকে পেয়েছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণভোমরা ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
আহমেদ জাভেদ বিদ্যমান শিক্ষা পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, এই শিক্ষা পদ্ধতি মানুষকে মুক্ত চিন্তা বা বিশ্ববীক্ষা দিতে পারছে না। ফলে শিক্ষা লাভ করে মানুষ সক্ষমতা বা স্বাধীনতা লাভ করছে না। সে কারণেই দেখা যায়, তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এখানে এক ধরনের আইনহীনতার উত্থান ঘটেছে।
অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনের বাঙালিত্বের ধারণা নিয়ে আলোচনা করেন সাংবাদিক প্রতীক বর্ধন। তিনি বলেন, অমর্ত্য সেন বাংলার সভ্যতাকে নদীজাত সভ্যতা বলে মনে করেন। বাংলার এই ভৌগোলিক রূপের কারণে বাঙালি জাতিসত্তা অন্তর্নিহিতভাবে সেক্যুলার বা পার্থিব। কিন্তু রাজনীতিকেরা নানাভাবে তা বিনষ্ট করেছেন। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সম্ভাবনা বিনষ্ট হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা যুক্ত হন। তাঁরা দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
অর্থসূচক/
			
						

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.