যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কে সুইস ঘড়ি শিল্পে বড় ধাক্কা, বিলাসবাজারে মন্দা

সাধারণত চীন ও ভারতের মতো দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক নিয়ে আলোচনা হলেও উন্নত দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ওপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই শুল্কযুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের ক্ষতিও কম হচ্ছে না। এদিকে মহামারির পর মন্দা, মূল্যস্ফীতি আর চীনের অর্থনৈতিক স্থবিরতা মিলিয়ে বিলাসপণ্যের বাজারে দীর্ঘস্থায়ী সংকট তৈরি হয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই শুল্ককে ‘সুইজারল্যান্ডের জন্য ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছেন সুইস বিলাসবহুল ঘড়ি কোম্পানি ব্রাইটলিংয়ের প্রধান নির্বাহী জর্জ কের্ন। এই শুল্কের জেরে সুইস ঘড়ির দাম বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে বিক্রি।

জর্জ কের্ন বলেন, ‘এটা ছিল ভয়ংকর খবর—৩৯ শতাংশ শুল্ক প্রকৃত অর্থেই বিপর্যয়কর।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুইস রাজনীতিকেরা এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা বুঝতেই পারেননি, ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যবসাবান্ধব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কীভাবে দর–কষাকষি করতে হয়।’

শুল্কের প্রভাব সামলাতে ব্রাইটলিং বিশ্বব্যাপী ঘড়ির দাম গড়ে ৪ শতাংশ বাড়িয়েছে। ফলে এসব ঘড়ির গড় মূল্য ৪ হাজার ৩০০ ডলার থেকে ৭ হাজার ২০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

চলতি বছরের আগস্ট মাসে হোয়াইট হাউস সুইস পণ্যের ওপর ৩৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের বড় বাণিজ্য–উদ্বৃত্ত আছে, যথারীতি এই কারণ দেখিয়ে শুল্ক আরোপ করা হয়। সুইস সরকার অবশ্য পাল্টা শুল্ক আরোপ না করে আলোচনার পথ বেছে নেয়। তবে এখন পর্যন্ত চুক্তি হয়নি।

ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে সুইস ঘড়ির রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে। ফেডারেশন অব দ্য সুইস ওয়াচমেকিং ইন্ডাস্ট্রি এ তথ্য জানিয়েছে। ব্যাংক বারক্লেস-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসেও রপ্তানি ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে।

সাধারণত সুইস ঘড়ির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। সেখানেই যেহেতু শুল্ক আরোপিত হয়েছে, সেহেতু রপ্তানিও কমেছে মূলত সেখানে। এপ্রিল ও জুলাই মাসে সম্ভাব্য শুল্ক ঘোষণার আশঙ্কায় রপ্তানি কিছুটা বেড়ে গেলেও আগস্টে তা ৫৬ শতাংশ কমে যায়। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্য ও জাপানে রপ্তানি বেশি ছিল।

জর্জ কের্ন স্বীকার করেন, বাজারে এখন কঠিন সময়। তাঁর ভাষায়, মহামারির পর মন্দা, মূল্যস্ফীতি আর চীনের অর্থনৈতিক স্থবিরতা মিলিয়ে বিলাসপণ্যের বাজারে দীর্ঘস্থায়ী সংকট তৈরি হয়েছে।

কের্ন তবুও আশাবাদী, ব্রাইটলিংয়ের মোট রাজস্বের মাত্র ৪–৫ শতাংশ চীন থেকে এলেও সম্প্রতি সেখানে বিক্রি বেড়েছে। তিনি বলেন, চীনের বাজারে গত কয়েক মাসে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। মনে হচ্ছে, পতনের ধারা থেমে বাজার স্থিতিশীল হয়েছে।

বার্নস্টাইনের গ্লোবাল লাক্সারি গুডস বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুকা সোলকা সিএনবিসিকে বলেন, চীনা ক্রেতাদের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই ধারা ২০২৫ সালের শেষ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত বজায় থাকলে বলা যায়, চীনের বাজারে অনেকটা ‘ইউ-আকৃতির’ পুনরুদ্ধার হবে।

তবে লুকা সোলকা সতর্ক করে বলেন, বিলাসবহুল ঘড়ির বাজার কিছু সময় চাপের মধ্যে থাকবে। তাঁর ভাষায়, ঘড়ি এমন জিনিস, যা মানুষ ঘন ঘন কেনে না; যারা কিনতে চেয়েছিল, তারা কোভিড-পরবর্তী চাঙা সময়ের মধ্যেই কিনে ফেলেছে, অর্থাৎ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে।
তবে জর্জ কের্ন মনে করেন না, বিলাসঘড়ির বাজারে বড় মন্দা এসেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দারুণ চাঙাভাব আসছে, ক্রেতাদের মনোভাবও ইতিবাচক।

তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। সেখানে বিক্রি খুবই ভালো। গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর বৈশ্বিক ভোক্তা মনোভাব আরও চাঙা হবে বলেও তিনি আশাবাদী। এদিকে জনসংখ্যাগত অনুকূল পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ ও লাতিন আমেরিকার বাজারে চাহিদা বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনেও বিক্রি বেড়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি আশাবাদী বলে মনে করেন কের্ন। তিনি বলেন, মানুষের স্বভাবজাত আশাবাদ আর বিলাসের প্রতি আবেগ কখনো শেষ হয় না। দীর্ঘ মেয়াদে বিলাসপণ্যের খাত বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্রগুলোর একটি হয়ে থাকবে।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.