চায়না ক্লে পাউডার ঘোষণায় ভারত থেকে আমদানি করা ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট (ভায়াগ্রা) আটক করে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভায়াগ্রা চালান হিসেবে চিহ্নিত।
রংপুর কাস্টমস এক্সাইস ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন হিলি স্থলবন্দরে এই বিপুল পরিমাণ ওষুধের কাঁচামাল জব্দ করেছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। উজালা পেইন্ট নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে এরইমধ্যে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা শুল্ক-করসহ জরিমানা এবং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চালানটি (ওষুধের কাঁচামাল) রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আমদানি করা চায়না ক্লে’র মধ্যে বিশেষ কায়দায় আমদানি হয়েছে ঘোষণা বহির্ভূত ওষুধের কাঁচামাল। তাও আবার এক বা দুই কেজি নয়, প্রায় ১৬ হাজার কেজি। ৩৭ ধরনের ওষুধের এই কাঁচামালের মধ্যে আমদানি হয়েছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আমদানি নিয়ন্ত্রিত ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট, যা ভায়াগ্রা নামে পরিচিত। এখন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
এর আগে ২০১৯ সালে বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে একটি ভায়াগ্রা চালান আমদানি হয়, যা পরে কাস্টমস আটক করে। যার মাধ্যমে তৎকালীন কাস্টমস কর্মকর্তারা চোরাচালানিদের রোষানলে পড়েন। তবে সে সময় ২ হাজার ৫০০ কেজি ভায়াগ্রা আটক হয়েছিল।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর দনিয়া কদমতলী এলাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোং।
প্রতিষ্ঠানটি ১ আগস্ট চায়না ক্লে পাউডার (রাবার গ্রেড) বা কাওলিনিকে ক্লে ঘোষণায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে একটি পণ্য চালান আমদানি করে। ৭ আগস্ট সিঅ্যান্ডএফ বাবুল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। কিন্তু ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য আমদানি হয়েছে এমন তথ্য থাকায় হিলি স্থল কাস্টমস স্টেশনের কর্মকর্তারা চালানটি আটক করে। পরে কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, চালানটিতে ১ হাজার ১১৪ বস্তা ৩০ হাজার ২৪৫ কেজি পণ্য রয়েছে। প্রতিটি বস্তার গায়ে ‘চায়না ক্লে পাউডার (রাবার গ্রেড)’ লেখা রয়েছে। পরে বস্তাগুলো খোলা হলে চায়না ক্লে’র ভেতরে একাধিক ছোট ছোট প্যাকেট পাওয়া যায়। তবে যেসব বস্তার মধ্যে প্যাকেট পাওয়া যায় সে সব বস্তার উপরে বিভিন্ন রকম সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। আবার এসব বস্তার মধ্যে একই রং ও বর্ণের পণ্য পাওয়া গেছে, যা চায়না ক্লে নয়। পরে ৭৩টি নমুনা সংগ্রহ করে কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষার জন্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) পাঠানো হয়। গত ২৬ আগস্ট কুয়েট থেকে রিপোর্টে সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
কায়িক পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমদানি করা ৩৮ ধরনের কাঁচামাল রয়েছে, যার গ্রস ওজন ৩০ হাজার ৬৮৮ কেজি, আর নেট ওজন ৩০ হাজার ২৮৫ কেজি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩১০ কেজি চায়না ক্লে। বাকি ১৫ হাজার ৯৭৫ কেজি ওষুধের কাঁচামাল। আবার ৩৭ ধরনের ওষুধের মধ্যে ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট বা ভায়াগ্রা। অন্যান্য কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে ৪২৫ কেজি সেটিরিজিন ডাই-হাইক্লোরাইড, ১৩২৫ কেজি ক্লোরফেনিরামিন ম্যালেট, ১০০ কেজি অ্যালজিনিক এসিড, ২ কেজি সিট্রাল, ৪৭ কেজি ক্যাফিন, ২২৫ কেজি সাইট্রিক এসিড, ৪২৫০ কেজি ওমেপ্রাজল, ২০৫ কেজি ডিএল-অ্যালানাইন, ১৭৬ কেজি সাইপ্রোহেপ্টাডিন হাইড্রোক্লোরাইড, ১৫০ কেজি এরিথ্রোমাইসিন, ২০ কেজি পলিঅ্যাক্রিলেট, ২৫০ কেজি সেলুলোজ, ১০০ কেজি রেসোরসিনল, ৫০ কেজি সাইপ্রোহেপ্টাডিন, ২৫ কেজি সিপ্রোফ্লক্সাসিন হাইড্রোক্লোরাইড, ৭৫ কেজি ডমপেরিডন, ২৫০ কেজি সিস্টাইন ডেরিভেটিভস মেডিসিন, ২৫ কেজি সোডিয়াম পিকোসালফেট, ২৩ কেজি মেলিট্রেসেন হাইড্রোক্লোরাইড, ১২৫ কেজি সোডিয়াম স্টার্চ গ্লাইকোলেট, ৩০০ কেজি কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ, ৬৫০ কেজি ফেক্সোপেনাডিন হাইড্রোক্লোরাইড, ২০০ কেজি পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৩৬ কেজি ডেক্সামেথাসোন, ২৫ কেজি সালবুটামল সালফাইট, ৭৫ কেজি ফ্লুক্লোক্সাসিলিন সোডিয়াম, ৩০০ কেজি প্রিপারজিন সাইট্রেট, ১০০ কেজি প্রো-মিথাজিন হাইড্রোক্লোরাইড, ২৮ কেজি সোডিয়াম স্টার্চ গ্লাইকোলেট, ২ কেজি লেভোফ্লক্সাসিন, ৩০০ কেজি লিডোকেইন হাইড্রোক্লোরাইড, ২০ কেজি অ্যাসিক্লোফেনাক, ২০০ কেজি অ্যাটেনোলল, ১৭৫ কেজি ক্লোরডায়াজেপক্সাইড, ১ কেজি প্রেডনিসোলন, ৫ কেজি ট্রেটিনয়েন।
ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২০২৪ অনুযায়ী ব্লক লিস্ট পণ্য, যা আমদানি করতে হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। আমদানিকারক অনুমতি ব্যতীত ওষুধের কাঁচামাল এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সিলডেনাফিল সাইট্রেট বা ভায়াগ্রা আমদানি করেছে। আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য চালানের প্রযোজ্য শুল্ককর ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩২৫ টাকা। তবে সঠিক এইচএস কোড অনুযায়ী আমদানি করা পণ্যের প্রযোজ্য শুল্ককর ১ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৯৭৩ টাকা। অসত্য ঘোষণায় প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘোষণাবহির্ভূত এবং অনুমতি ব্যতীত ওষুধের কাঁচামাল, জনস্বাস্থ্যের জন্য ভায়াগ্রা আমদানি করায় প্রতিষ্ঠানকে ২১ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ৬ অক্টোবর নোটিশের জবাব দেয়। যেখানে ভারতের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের গুদাম থেকে ভুলে ওষুধের কাঁচামাল চায়না ক্লের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজ ইচ্ছায় আনেনি বলে জানায়। তবে ওষুধের কাঁচামাল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ভায়াগ্রা আমদানিতে আমদানিকারক কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
গত ১৪ অক্টোবর রংপুর কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের বিচারাদেশে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চালানটি (ওষুধের কাঁচামাল) রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে আমদানি করা চায়না ক্লে’র শুল্ককর পরিশোধ সাপেক্ষে বাজেয়াপ্তের পরিবর্তে এক লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা ও প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যক্তিগত জরিমানা আরোপ করা হয়।
সিলডেনাফিল সাইট্রেট হচ্ছে ভায়াগ্রার সক্রিয় উপাদান, যা সাধারণত ২৫ মিলিগ্রাম, ৫০ মিলিগ্রাম ও ১০০ মিলিগ্রাম ডোজে ট্যাবলেট আকারে বিক্রি হয়। আটক করা ৫ হাজার ৮০৫ কেজি ভায়াগ্রার কাঁচামাল দিয়ে ২৫ মিলিগ্রামের ২৩ কোটি ২২ লাখ ট্যাবলেট, ৫০ মিলিগ্রামের ১১ কোটি ৬১ লাখ এবং ১০০ মিলিগ্রামের ৫ কোটি ৮০ লাখ ট্যাবলেট তৈরি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.