বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা: ব্র্যান্ডিং ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ আজ আর শুধু পোশাক শিল্পনির্ভর অর্থনীতি নয়; এটি ধীরে ধীরে একটি বহুমুখী রপ্তানি সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও এখন কৃষিপণ্য, হিমায়িত মাছ, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক, আইটি সেবা, এমনকি হস্তশিল্পও আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু উৎপাদন নয়, ব্র্যান্ডিং এবং স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনই এখন মূল চাবিকাঠি।

নতুন বাজারের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বাজারের চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে। এসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে, কিন্তু একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা এবং পণ্যের গ্লোবাল ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। একই মানের পণ্য ভারত, ভিয়েতনাম বা তুরস্ক থেকে এলে তাদের প্যাকেজিং, ব্র্যান্ড নাম, সার্টিফিকেশন ও অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।

ব্র্যান্ডিং কেন জরুরি
বাংলাদেশের অনেক ভালো পণ্য, যেমন- রাজশাহীর আম, নওগাঁর চাল, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কিংবা রাঙামাটির হস্তশিল্প-বিদেশে “বাংলাদেশি ব্র্যান্ড” হিসেবে পরিচিত নয়। বিদেশি ক্রেতারা জানে না যে এগুলো কোথা থেকে এসেছে। অথচ, ব্র্যান্ডিংই একটি দেশের পণ্যকে ‘গ্লোবাল শেলফে’ স্থান দেয়।

যেমন, “Made in Bangladesh” ট্যাগটি একসময় কেবল পোশাক শিল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন এটিকে বিশ্বমানের মানচিহ্নে রূপান্তর করা সম্ভব-যদি আমরা প্রতিটি পণ্যের জন্য মানসম্পন্ন প্যাকেজিং, লোগো, এবং ডিজিটাল প্রোমোশন নিশ্চিত করতে পারি।

স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ও মান নিয়ন্ত্রণ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ISO, HACCP, Halal, GMP ইত্যাদি সার্টিফিকেশন এখন আর বিলাসিতা নয়- এগুলো হলো প্রবেশপত্র। অনেক সময় মান ও লেবেল সংক্রান্ত জটিলতায় আমাদের পণ্য সীমান্তেই আটকে যায়। যদি আমরা উৎপাদন পর্যায় থেকে মান নিয়ন্ত্রণ, ট্রেসেবিলিটি ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারি, তাহলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। এই জায়গায় এফবিসিসিআই (FBCCI) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এফবিসিসিআইয়ের ভূমিকা
বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে এফবিসিসিআই দেশের রপ্তানি খাতকে নতুন দিশা দিতে পারে তিনটি মূল মাধ্যমে-

পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ে সমন্বিত উদ্যোগ:
সরকার, বেসরকারি খাত ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্র্যান্ড উন্নয়ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা যেতে পারে।
স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ও সার্টিফিকেশন সহায়তা:
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনে উদ্যোক্তাদের ট্রেনিং, সার্টিফিকেশন সহায়তা ও টেস্টিং ল্যাবের সংযোগ তৈরি করা।
নতুন বাজার অনুসন্ধান ও ট্রেড মিশন:
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি পণ্য প্রচারে ট্রেড ফেয়ার, প্রদর্শনী ও B2B মিটিং আয়োজন করা।

রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপ
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। তবে আমাদের রপ্তানি এখনো মোট GDP-র তুলনায় অনেক কম। এই হার বাড়াতে হলে শুধু উৎপাদন নয়, উদ্ভাবন, প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং ও সাপ্লাই চেইন দক্ষতা বাড়াতে হবে। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যদি জানেন তার পণ্যের মান বিশ্বমানের, এবং সেই পণ্যটি “Bangladesh Brand” হিসেবে বিদেশে মূল্য পায়—তাহলেই আমরা সত্যিকারের রপ্তানি বিপ্লবের পথে এগোতে পারব।

রপ্তানি এখন শুধু বাণিজ্য নয়, এটি একটি জাতির পরিচয়ের প্রতিফলন। “Made in Bangladesh” যেন শুধু একটি ট্যাগ নয়, বরং গুণগত মান, সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক হয়-এই লক্ষ্যেই আমাদের এগোতে হবে। এফবিসিসিআই যদি নেতৃত্ব দেয় ব্র্যান্ডিং ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের এ আন্দোলনে, তবে বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্ববাজারে একটি বিশ্বস্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

 

লেখক- সাবিনা ইয়াসমীন, ম‍্যানেজিং ডিরেক্টর, প্রচিত আইএমসি লিমিটেড

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.