সংকটেও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস

অর্থসূচককে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আলী নেওয়াজ

মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ। দেশের প্রথিতযশা একজন হিসাববিদ ও ওষুধ শিল্পখাতের বিশেষজ্ঞ। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি নুভিস্তা ফার্মা, সিনোভিয়া ফার্মা পিএলসি, বাংলাদেশ এন্টিবায়োটিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মা এপিআই লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। তিনি ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে পেশাদার হিসাববিদদের প্রতিষ্ঠান আইসিএমএবি’র সদস্য। অর্থসূচককে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি দেশের ওষুধ শিল্প ও বেক্সিমকো ফার্মার নানা দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছে অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান ও স্টাফ রিপোর্টার মাসুমুর রহমান।

অর্থসূচকঃ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা কেমন?

মোহাম্মদ আলী নেওয়াজঃ আমাদের ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকাশমান শিল্পের একটি। ২০১০ সালের পর থেকে টানা ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এই শিল্পে। কোভিডকালীন সময় ছাড়া আর কোনো সময়ই নেগেটিভ গ্রোথ হয়নি। দেশের অর্থনীতি বেড়েছে, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় বেড়েছে, সাধারণ মানুষের আয় ও জীবনমান উন্নত হয়েছে। উপজেলা পর্যায়েও এখন হাসপাতাল, ডাক্তার ও চিকিৎসার সুযোগ আছে। ফলে মানুষ ডাক্তারের পরামর্শে পূর্ণ কোর্সের ওষুধ কিনছে। এ ছাড়া প্রতিবছর বড় কোম্পানিগুলো ২০–৩০টি নতুন ওষুধ বাজারে আনছে। বর্তমানে বাজারের আকার প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। মোট ওষুধের প্রায় ৯৮% দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বাকী যেটুকু আমদানি করা হয়, সেগুলো উৎপাদন করা লাভজনক নয়। কারণ এগুলোর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি, অন্যদিকে চাহিদা অনেক কম। তাই এগুলো উৎপাদন করলে আমদানি কর করা ওষুধের চেয়ে দাম বেশি পড়বে।

অর্থসূচকঃ দেশের বাজারে বেক্সিমকো ফার্মার অবস্থান কোথায়?

মোহাম্মদ আলী নেওয়াজঃ দেশের ওষুধের বাজারে বেক্সিমকো ফার্মার অবস্থান বেশ জোরালো। ইনহেলার উৎপাদনসহ অনেক বড় ও নতুন মাইলফলকের সঙ্গে এ কোম্পানির নাম জড়িয়ে আছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বেক্সিমকো ফার্মা ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সর্বোচ্চ মান ধরে রেখেছে। এ কারণে আমাদের উৎপাদিত ওষুধের উপর সাধারণ মানুষ, চিকিৎসকসহ সবার আস্থা রয়েছে। রপ্তানি বাজারেও আমাদের রয়েছে শক্ত পদচারণা। বেক্সিমকো ফার্মা দেশের একমাত্র কোম্পানি, যা বিদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

অর্থসূচকঃ দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশের ওষুধের বাজারে বেক্সিমকো ফার্মা দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। কোম্পানিটি এ অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি কেন?

মোহাম্মদ আলী নেওয়াজঃ নানা কারণে বেক্সিমকো ফার্মা দ্বিতীয় অবস্থানটি ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে ওষুধের বাজারে আমাদের অবস্থান তৃতীয়। আগের জায়গাটি ধরে রাখতে না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে, সময়মতো বিনিয়োগ না করা। দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে নতুন বিনিয়োগ ছিল না। উৎপাদনক্ষমতা না বাড়লে এবং উৎপাদনে বৈচিত্র্য না এলে বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। তবে ২০০৬ সালে আমরা উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন বিনিয়োগ করতে শুরু করি। ইতোমধ্যে বেক্সিমকো ফার্মা বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েছে। এছাড়া দুটি বহুজাতিক কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করেছে, যা শুধু আমাদের সক্ষমতা বাড়ায়নি, আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২২ সালে আমরা নতুন একটি ফ্যাক্টরি চালু করেছি, যার প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন এক লাখ স্কয়ার ফুট। এ স্থাপনা নির্মাণে আমরা দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। এই ফ্যাক্টরি নির্মাণ করার ফলে আগামী ১৫/২০ বছরে আর কোনো ভৌত স্থাপনা তৈরি করতে হবে না। শুধু বিদেশ থেকে মেশিনারিজ এনে স্থাপন করলেই উৎপাদন শুরু করা যাবে।

অর্থসূচকঃ গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গ্রুপের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিক-কর্মচারি ছাঁটাই হয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মার কী অবস্থা?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেক্সিমকো ফার্মাকে খুবই কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। আমাদের অফিস ও ডিপোতে হামলা হয়েছে, ৪-৫টি ডিপো ও প্রধান কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে সুনামের ওপর। নামের আগে ‘বেক্সিমকো’ থাকায় অনেক নেতিবাচক প্রচার হয়েছে। এমনকি আমাদের আরজেএসসিতে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার অ্যাকসেস বন্ধ রাখা হয়েছিল। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে ছয় সপ্তাহ সময় লেগেছে। অনেক ডাক্তার তখন বেক্সিমকো ফার্মার ওষুধ লিখা বন্ধ করে দেন।

তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা হাল ছাড়িনি। কয়েক দিনের মধ্যেই উৎপাদনে ফিরেছি। আমাদের কোনো শ্রমিক-কর্মচারিকে চাকরি হারাতে হয়নি, কেউ নিজে থেকেও চাকরি ছেড়ে যাননি।  আমরা সম্মিলিতভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করেছি। সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, নামের আগে বেক্সিমকো থাকলেও এটি মূলত: জনগণের কোম্পানি। কারণ এ কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের শেয়ার মাত্র ১৪ শতাংশ। বাকী ৮৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। একটু বিলম্বে হলেও আমরা প্রশাসনকে পাশে পেয়েছি। চিকিৎসকরাও আগের মতো ওষুধ লিখছেন। সর্বশেষ বছরেও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

অর্থসূচকঃ  এত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারার রহস্যটা কী?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারার পেছনে মূলত: তিনটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে।  প্রথমত, বেক্সিমকো ফার্মার ম্যানেজমেন্ট সব সময় পেশাদারদের হাতেই থেকেছে। অনেক বছর আগে আমাদের বোর্ডের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছিল যে, তারা দৈনন্দিন কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তাই রাজনৈতিক পরিবর্তনে কোম্পানির উদ্যোক্তারা নানা সমস্যায় পড়লেও বেক্সিমকো ফার্মার উপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। আমরা আগের মতোই স্বাধীনভাবে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে পারছি।

দ্বিতীয়ত, কোম্পানির মার্কেটিং টিম এই প্রতিকূল সময়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করেছে। তারা চিকিৎসকসহ সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, এটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন কোম্পানি।

তৃতীয় ও প্রধান বিষয় ছিল বেক্সিমকো ফার্মার ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মান ও সুনাম। এ কোম্পানির ওষুধের উপর রোগী ও চিকিৎসকদের ব্যাপক আস্থা রয়েছে।

অর্থসূচকঃ বেক্সিমকো গ্রুপের বিশাল ব্যাংকঋণ নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। বেক্সিমকো ফার্মার ঋণ পরিস্থিতি কেমন?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ অনেক হলেও ফার্মার ক্ষেত্রে কিন্তু চিত্র কিছুটা ভিন্ন। আমাদের ঋণ সম্পর্কে নানা অপপ্রচার আছে। কেউ কেউ প্রচার করেছে যে, বেক্সিমকো ফার্মার ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ ছিল, সেটি বাঁকা পথে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এটি মোটেও বস্তুনিষ্ট তথ্য নয়। এই কোম্পানির কখনো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ ছিল না। অথচ এই একটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রিসিভার নিযোগের জন্য আদালতে রিট করা হয়। কোর্ট এটির উপর ভিত্তি করে একটি অর্ডারও দিয়ে দেয়। অথচ বেক্সিমকো ফার্মার ইতিহাসে চলতি ঋণ হিসেবে সর্বোচ্চ ঋণসীমা ছিল ৬০০ কোটি টাকা। যেদিন আদালতে রিট দায়ের করা হয়, সেদিন কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র দেড়শ কোটি টাকা। আমাদের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে দেড়শ কোটি টাকার ঋণ অতি নগন্য। আমাদের কোনো অনিয়মিত ঋণ নেই। বেক্সিমকো ফার্মার ইতিহাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার কোনো ঘটনা নেই।

জনতা ব্যাংকে আমাদের ওভারড্রাফট ফেসিলিটি আছে ৬০০ কোটি টাকা, এলসি ফেসিলিটি আছে ৭০০ কোটি টাকা। আর ব্যাংক গ্যারান্টি ও অন্যান্য আছে ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমাদের এলসি ফেসিলিটির পূর্ণ ব্যবহার হয়, কারণ আমরা ৪/৫ মাসের কাঁচামাল সব সময় মজুদ রাখি। এই মুহূর্তে ওভারড্রাফট ফেসিলিটি ব্যবহারের পরিমাণ শত কোটি টাকারও কম।

অগ্রণী ব্যাংকের ৩৭৫ কোটি টাকার একটি ঋণ ছিল। সেটি সানোফিকে অধিগ্রহণের সময় নেওয়া হয়েছিল।  সেটির নিয়মিত কিস্তি শোধ হচ্ছে। বর্তমান স্থিতির পরিমাণ ৮৩ কোটি টাকা।

২০০৬ সালে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, কোম্পানিকে দ্রুত বড় করবো। তার জন্য প্রয়োজন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো। ওই সিদ্ধান্তের পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

অর্থসূচকঃ বেক্সিমকো গ্রুপের অনেক কোম্পানিই লোকসানি। অভিযোগ আছে যে, বেক্সিমকো ফার্মার মুনাফার একটি অংশ গোপনে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোম্পানিগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সিএফও হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ এটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি গুজব। এর সামান্যতম সত্যতা নেই। বেক্সিমকো ফার্মা একটি কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান। এই কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ নেই। তাছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপ আকারে অনেক বড়। একটি কোম্পানির মুনাফা থেকে এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে সাপোর্ট দেওয়া কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। তাছাড়া বেক্সিমকো ফার্মা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। তাদের মনোনীত একটি প্রতিষ্ঠান ফার্মার কার্যক্রম ও আর্থিক বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে মনিটর করে থাকে।

অর্থসূচকঃ বেক্সিমকো ফার্মাসহ বেশ কিছু কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। ওষুধ রপ্তানিতে  বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কতটুকু?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ ওষুধের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। প্রতি বছরই ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের বাজারে নতুন নতুন ওষুধ নিবন্ধন পাচ্ছে। তবে ওষুধ রপ্তানিতে রাতারাতি বড় কোনো উন্নতি সম্ভব নয়। কারণ ওষুধ রপ্তানির বিষয়টি আর পাঁচটি পণ্য রপ্তানির মত নয়। রপ্তানির জন্য খুবই জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশেও ওষুধ রপ্তানি করতে হলে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ওই দেশে এজেন্ট নিয়োগ করে অথবা লিয়াজো অফিস স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিটি ধারণ করার ব্যবস্থা করতে হয়। তারপর ওই দেশের ওষুধ নিবন্ধনের প্রটোকল সংগ্রহ করে সে অনুসারে নথিপত্র (Dosier) তৈরি করে আবেদন জমা দিতে হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রথমে ওই দেশের ওষুধ প্রশাসনের প্রতিনিধি দল এসে প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে। তারা ইতিবাচক সার্টিফিকেট দিলে আলাদা করে বিভিন্ন ওষুধের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওষুধ কোম্পানি একটি দেশে তাদের ওষুধ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। এই চাপের কারণে আফ্রিকার কোনো দেশেও একটি ওষুধের নিবন্ধন পেতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লেগে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘ, সেখানে প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগে যায়। খরচও বিপুল; শুধু মার্কিন নিবন্ধনের ফি মাঝারি কোম্পানির জন্য এক মিলিয়ন ডলারের বেশি। বেক্সিমকো ফার্মা প্রতিবছর লাইসেন্স ও অডিট বজায় রাখতেই দেড় মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।

অর্থসূচকঃ বেক্সিমকো ফার্মার রপ্তানির অবস্থা কী?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ বেক্সিমকো ফার্মা বর্তমানে বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে প্রায় ২৫০ ধরনের ওষুধ রপ্তানি করছে। সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বেক্সিমকো ফার্মার ২০টি ওষুধের নিবন্ধন আছে। বর্তমানে আমরা ৮টি ওষুধ রপ্তানি করছি। নিবন্ধিত বাকী ওষুধগুলোর রপ্তানিও পর্যায়ক্রমে শুরু হবে বলে আশা করছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আয় প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার। লাভজনক হতে হলে অন্তত ১০-১৫ মিলিয়নের ওপরে আয় করতে হয়; কারণ, খরচ বেশি। তবে একবার ইউএস এফডিএ সার্টিফিকেশন পাওয়া গেলে অন্য দেশে অনুমোদন পাওয়া সহজ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়া আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাজার।

 

অর্থসূচকঃ আগামী বছর বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের কথা। এ বিষয়টি ওষুধ শিল্পে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ওষুধ শিল্প নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে আমরা পেটেন্টে ছাড় পাই। তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো নতুন ওষুধ এলে কোনো অনুমতি বা লাইসেন্স ছাড়াই তা উৎপাদন করতে পারি। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ সুবিধা থাকবে না। তখন যে কোম্পানি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করবে, তার অনুমতি ও লাইসেন্স নিয়েই কেবল ওই ওষুধ উৎপাদন করা যাবে। লাইসেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে রয়্যালটি বা ফি দিতে হবে। তাছাড়া তাদের নির্ধারিত কোম্পানির কাছ থেকে কাঁচামাল কিনতে হলে কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি ব্যয় হবে। সব মিলিয়ে বাজারে ওষুধের দাম অনেক বেড়ে যাবে। অন্য কারণেও ওষুধের দাম অনেক বেড়ে যাবার আশংকা আছে। বর্তমানে লাইসেন্স প্রয়োজন হয় না বলে কোনো একটি ওষুধ আবিস্কারের পর একাধিক কোম্পানি দেশে সেটি উৎপাদন করে। বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে কোনো কোম্পানি চাইলেও ওই ওষুধের বেশি নির্ধারণ করতে পারে না। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর বিদেশী কোম্পানির কোনো একটি ওষুধ লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশে শুধু একটি কোম্পানিই উৎপাদন করতে পারবে। তাতে ওউ ওষুধ ও তার দামের ওপর কোম্পানিরটির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এসব কারণে অনেক ওষুধ রোগীদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যেতে পারে। তাতে ওষুধের বিক্রি কমে যাবে। ছোট হয়ে আসবে ওষুধের বাজার। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কোম্পানিগুলোর মুনাফায়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কোম্পানিগুলোকে অনেক লাইসেন্স কিনতে হবে, এর জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল বিনিয়োগ। অনেক কোম্পানি প্রচণ্ড চাপে পড়বে। অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

বিদেশি কোম্পানিগুলো যদি ইতিমধ্যে বাজারজাত করা তাদের পেটেন্টকৃত ওষুধের জন্য রয়্যালটি দাবি করে বসে, তাহলে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বড় ধরনের আর্থিক চাপের মুখে পড়তে হবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে রপ্তানি বাজারেও আমাদেরকে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। অনেক দেশ আমাদের জেনেরিক ওষুধ আমদানি করতে পারবে না। তাতে রপ্তানি কমে যাবে। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ওষুধ উৎপাদনের পর রপ্তানি করা হলেও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বর্তমানের মতো থাকবে না।

অর্থসূচকঃ এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় বেক্সিমকো কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ সম্মিলিত এবং একক-দুই ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সক্রিয় সদস্য। সমিতির মাধ্যমে আমরা নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার চেষ্টা করছি। সমিতির পক্ষ থেকে এলডিসি উত্তরণের প্রভাবগুলো সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি উত্তরণের সময়সীমা তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

যদি নির্ধারিত সময়ে এলডিসি উত্তরণ এড়ানো না যায় তাহলে যাতে বড় ধরনের সংকটে পড়তে না হয়, সে প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছি আমরা। ইতোমধ্যে বেক্সিমকো ফার্মা দুটি বহুজাতিক কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে। ফলে এ কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত ওষুধ সহজেই আমরা বাজারজাত করতে পারবো। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের যোগাযোগের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমরা আগামী দিনে আরও অনেক বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে তাদের প্যাটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারবো।

অর্থসূচকঃ বেক্সিমকো ফার্মার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মোহাম্মদ আলী নাওয়াজঃ বেক্সিমকো ফার্মার মূল দৃষ্টি এখন বায়োলজিকসের দিকে; বিশেষ করে অ্যান্টি ক্যানসার ও অ্যান্টি ডায়াবেটিস ওষুধে। বিশ্বজুড়ে এগুলোই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশে প্রথমেই এসব পণ্য আনতে। বর্তমানে আমরা কিছু এন্টি-ক্যান্সার ওষুধ বাজারজাত করছি। তবে সেগুলো আমাদের উৎপাদিত পণ্য নয়, আমদানিকৃত। আগামী এক দুবছরের মধ্যে আমরা এন্টি-ক্যান্সারের নিজস্ব ওষুধ বাজারে নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করছি। এছাড়া এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আগে দ্রুত নতুন কিছু ওষুধ রেজিস্ট্রেশন করে রাখতে চাই; যাতে বলা যায়, এগুলো এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বাজারে এসেছে; প্যাটেন্টের খাঁড়ায় না পড়তে হয়। এ ছাড়া নোভিস্তা ফার্মা ও সাইনোভিয়া ফার্মা নামক দুটি বহুজাতিক কোম্পানির বাংলাদেশের শেয়ার আমরা কিনে নিয়েছি; যাতে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হয়।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.