লাদাখে জেন-জি প্রজন্মের বিক্ষোভ ভয়াবহ সংঘর্ষে রুপ নিয়েছে

ভারতে হিমালয়ের সীমান্ত অঞ্চল লাদাখে জেন-জি প্রজন্মের বিক্ষোভ ভয়াবহ রক্তপাতের জন্ম দিয়েছে। সাংবিধানিক সুরক্ষা ও রাজ্য মর্যাদার দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন।

সহিংস এই আন্দোলনে বিজেপির কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, হিমালয়ের উচ্চভূমির শীতল মরুভূমি অঞ্চল লাদাখে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবারই দেখা দিয়েছে ভারত-চীন উত্তেজনা। আর সেখানেই বুধবার জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে ভয়াবহ বিক্ষোভ শুরু হয়। ক্ষুব্ধ তরুণরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির আঞ্চলিক কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।

লাদাখের আঞ্চলিক রাজধানী লেহ শহরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে অন্তত চারজন নিহত ও আরও বহু মানুষ আহত হয়। আন্দোলন সমন্বয়কারীরা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, পরে সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীরও বহু সদস্য আহত হয়েছে।

গত ছয় বছর ধরে লাদাখের মানুষ স্থানীয় সিভিল সংগঠনের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, অনশন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবি— রাজ্য মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক সুরক্ষা। কিন্তু বুধবার ক্ষুব্ধ তরুণরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভেঙে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।

শিক্ষক সোনাম ওয়াংচুক বহু অনশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ভিডিও বার্তায় বলেন, “এটা তরুণদের এক ধরনের বিস্ফোরণ— একটা জেন-জি বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর কাজে আসছে না বলে তারা মনে করেছে।”

তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গে নেপালসহ সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তুলনাও টানেন।

কীভাবে শুরু হলো সংঘর্ষ?
বুধবার সকালে লাদাখ এপেক্স বডির নেতৃত্বে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের অনশন ১৫তম দিনে প্রবেশ করে। আগের রাতে দুই প্রবীণ অনশনকারীকে হাসপাতালে নিতে হয়। এর পর সংগঠকেরা লকডাউনের ডাক দেন। একই সঙ্গে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় বিলম্বে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

এ পরিস্থিতিতে তরুণরা আন্দোলনের কেন্দ্র মার্টিয়ার্স মেমোরিয়াল পার্ক থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সরকারি ভবন ও বিজেপি কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এতে চারজন নিহত, আরও অনেকে আহত হন। আহতদের মধ্যে একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।

লাদাখ এপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর বলেন, “এটা লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। যারা রাস্তায় দাবি আদায়ে নেমেছিল, তাদের হত্যা করা হলো।”

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “অশান্ত ভিড়ের” সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০ জনের বেশি পুলিশ আহত হয়েছে এবং আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, ওয়াংচুক আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েছেন।

মোদি সরকারের অভিযোগ, ওয়াংচুক বিক্ষোভকারীদের উসকে দিয়েছেন। তিনি আরব বসন্তধর্মী আন্দোলন ও নেপালের জেন-জি বিক্ষোভের উল্লেখ করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে ওয়াংচুক জোর দিয়ে বলেন, তিনি কখনোই সহিংসতার আহ্বান জানাননি, বরং সতর্ক করেছিলেন যে দাবিগুলো উপেক্ষা করলে তরুণদের ক্ষোভ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলো কী?
২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও রাজ্য পদমর্যাদা বাতিল করে। তখন ওই রাজ্যের তিনটি অঞ্চল ছিল— মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির উপত্যকা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং মুসলিম-বৌদ্ধ সমান জনসংখ্যার লাদাখ।

পরে জম্মু-কাশ্মিরকে একটি আইনসভাসহ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং লাদাখকে আইনসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানানো হয়। এতে জম্মু-কাশ্মিরের জনগণ অন্তত স্থানীয় নেতাদের নির্বাচিত করতে পারে, কিন্তু লাদাখ পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক শাসনে চলে যায়।

লাদাখের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘তফসিলি জনজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তাই তারা ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক সুরক্ষা চাইছেন, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে বিদ্যমান।

কিন্তু মোদি সরকার এ পর্যন্ত রাজ্য মর্যাদা কিংবা ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষা কোনোটাই দিতে রাজি হয়নি।

এর ফলে কর্মসংস্থানও কঠিন হয়ে পড়েছে। আগে জম্মু-কাশ্মির একত্রে থাকায় লাদাখের লোকজনও সেখানকার চাকরিতে আবেদন করতে পারতেন। এখন সেটা আর সম্ভব নয়। স্থানীয়রা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ নীতির অস্পষ্টতার অভিযোগও করেছেন।

ওয়াংচুক বলেন, “তরুণরা পাঁচ বছর ধরে বেকার, আর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে— এটাই সমাজে অশান্তির কারণ।”

লাদাখে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ, যেখানে ভারতের গড় মাত্র ৮০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালের জরিপে দেখা গেছে, লাদাখের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ২৬.৫ শতাংশ বেকার— যা ভারতের জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।

কেন লাদাখ গুরুত্বপূর্ণ?
লাদাখ ভারতের হিমালয় সীমান্তে অবস্থিত, চীনের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে এখানে। এই অঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি গিরিপথ, বিমানঘাঁটি ও সরবরাহপথ রয়েছে, যা ভারত-চীন যুদ্ধে সামরিক দিক থেকে অপরিহার্য।

২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তাতে অন্তত ২০ ভারতীয় ও ৪ চীনা সেনা নিহত হয়। এরপর থেকে দুই দেশ সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ২০১৯ সালে মোদি সরকারের পদক্ষেপের ফল এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। আগে কাশ্মির ছিল অশান্তির কেন্দ্র, এখন লাদাখও তাতে যোগ হলো।

অতীতেও কি লাদাখে আন্দোলন হয়েছে?
হ্যাঁ। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও অনশন করেছে। ওয়াংচুক গত তিন বছরে পাঁচবার অনশন করেছেন। তার জীবন কাহিনী বলিউডের এক জনপ্রিয় সিনেমার অনুপ্রেরণা হয়ে চীনে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

যে শহীদ স্মৃতি উদ্যানে অনশন চলছিল, সেটি ১৯৮৯ সালের আগস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত তিন লাদাখির স্মৃতিতে তৈরি। তখন কাশ্মিরি আধিপত্যের অভিযোগে প্রতিবাদ হয়েছিল। এখানেই ১৯৮১ সালে তফসিলি জনজাতির মর্যাদার দাবিতে নিহত দু’জনকেও স্মরণ করা হয়।

কিন্তু বুধবারের বিক্ষোভ লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা হয়ে রইল।

সরকারি আলোচক কমিটির সদস্য সাজাদ কারগিলি বলেন, “এই সহিংসতা আমাদের তরুণদের হতাশা স্পষ্ট করে দিয়েছে। সরকারকে বুঝতে হবে, সবাই শান্তিপূর্ণ অনশনে বসবে না। তরুণদের রাগ এখন বিস্ফোরণ হচ্ছে।”

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.