অর্থনৈতিক দুর্যোগ কাটিয়ে শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এখন তারা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখছে। রেকর্ড পরিমাণ সরকারি মূলধন ব্যয়ের কল্যাণে দেশটি আশা করছে, ২০২৬ সালে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। যদিও চলতি বছর কাঙ্ক্ষিত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত না–ও হতে পারে।
২০২২ সালে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার দুই বছরের মধ্যেই শ্রীলঙ্কা জোরালোভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে দেশটির অথনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৫ শতাংশ। তবে চলতি ২০২৫ সালের বাজেট পাসে দেরি হওয়ায় সরকারি ব্যয় কমেছে। তার জেরে এ বছর প্রবৃদ্ধি ৪ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর গণমাধ্যমের।
শ্রম ও অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক উপমন্ত্রী অনীল জয়ন্তা ফার্নান্দো বলেছেন, স্বাধীনতার পর ২০২২ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। এখন সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথে। এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের উচিত অর্থনীতি নিয়ে ‘আশাবাদী’ হওয়া।
উপমন্ত্রী অনীল জয়ন্তা ফার্নান্দো বলেন, ‘আগামী বছর আমাদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা সেদিকেই অগ্রসর হব।’ তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে, অর্থাৎ পাঁচ বছর পর আমাদের লক্ষ্য হবে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর পর্যায়ে উন্নীত করা, প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ।’ ২০২৬ সালে সরকার উন্নয়ন ব্যয় ৮ শতাংশ বাড়িয়ে রেকর্ড ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি রুপি বা ৪৬৪ কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ২০২৩ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা দিয়েছিল। সংস্থাটি এ বছর শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সরকারি হিসাবে, চলতি ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে শ্রীলংকা সরকার।
উপমন্ত্রী অনীল জয়ন্তা ফার্নান্দো বলেন, ‘আগামী বছর সবকিছু বদলে যাবে, এমন দাবি আমরা করছি না। তবে জনগণ, বিশ্ব সম্প্রদায় ও বিনিয়োগকারীদের বলছি, আশাবাদী থাকুন। এরকম পূর্বাভাস আগামী বাজেটে আসতে পারে।’
বাজেট পাসে বিলম্ব
২০২৫ সালের জন্য শ্রীলঙ্কা মূল উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ রেখেছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি রুপি। তবে প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে নতুন সরকার দেরিতে বাজেট অনুমোদন করায় ব্যয় পিছিয়ে যায়। দেশটি সাধারণত নভেম্বরে মাসে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করে এবং ডিসেম্বরে অনুমোদন দেয়। এ বছর সেই নিয়মে ফেরার পরিকল্পনা আছে তাদের।
উপমন্ত্রী অনীল জয়ন্তা ফার্নান্দো বলেন, এ বছর বাজেট অনুমোদনে দেরি হওয়ায় অনেক মন্ত্রণালয় ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করতে দ্বিধায় ছিল। দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যয় বাড়লেও তা এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। ফলে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি সেই ক্ষতি পূরণ না করলে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন। জুলাই শেষে বাজেটের মাত্র পাঁচ ভাগের একভাগ খরচ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাভাবিক বাজেট চক্রে ফিরব। ফলে আগামী বছর সব ঠিকঠাক চলবে। আমরা নতুন হওয়ায় কিছুটা শিক্ষা পেয়েছি।’
ঋণের ধরন পরিবর্তন
উপমন্ত্রী অনীল জয়ন্তা ফার্নান্দো আরও জানান, ২০২৬ সালে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দ্বিগুণের বেশি হয়ে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের ওপর যেতে পারে। মূলত চীন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এই এফডিআই প্রবাহ আসবে। শ্রীলঙ্কা এখন বড় প্রকল্প ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সঙ্গে যুক্ত কৌশলগত বৈদেশিক ঋণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। মজুত বাড়ানো বা পুরোনো উদ্যোগ চালাতে বাজারভিত্তিক যে ঋণ নেওয়ার রীতি ছিল, সেই পথ থেকে সরে আসছে দেশটি।
অত্যধিক ঋণের বোঝায় জর্জরিত দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাঠামোর মধ্যে থেকে ঋণ কমানোর পথে কাজ করছে। লক্ষ্য—২০৩২ সালের মধ্যে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৯৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। সেই লক্ষ্যের আরও আগ্রাসী রূপ হলো এই অনুপাত ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০৯ দশমিক ৬ শতাংশ।
ফার্নান্দো আরও বলেন, কেবল জরুরি বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও পর্যটন খাতে গতি এনে বৈদেশিক মজুত শক্তিশালী করায় জোর দেবে সরকার।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বছরের প্রথম ৮ মাসে ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ৫২০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এ বছর তা রেকর্ড ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার স্পর্শ করতে পারে। গত বছর প্রবাসী আয় এসেছিল ৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন বা ৬৫৭ কোটি ডলার। এর আগে সবচেয়ে বেশি এসেছিল ২০১৬ সালে—৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন বা ৭২৪ কোটি ডলার।
ঋণসংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ছিল করুণ। ২০২২ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি মূল্যহ্রাসের ধারায় নেমে এসেছে। কঠোর মুদ্রানীতি, রাজস্ব সংস্কার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তায় পরিচালিত পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.