ডিজিটাল অ্যারেস্ট প্রতারণায় কয়েক কোটি টাকা খোয়ালেন ভারতীয় নারী

অঞ্জলির (ছদ্মনাম) দুঃস্বপ্নের শুরু হয় একটি ফোন কল থেকে। শেষপর্যন্ত তার এই বিভীষিকা গিয়ে ঠেকে পাঁচ কোটি পঁচাশি লাখ টাকা হারানোর মধ্য দিয়ে। ফোন কলে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি নিজেকে একটি কুরিয়ার সংস্থার কর্মচারী পরিচয় দিয়ে দাবি করেন, মুম্বাই কাস্টমস বেইজিংয়ে পাঠানোর সময় অঞ্জলির একটি পার্সেল বাজেয়াপ্ত করেছে এবং সেই পার্সেলে মাদক পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর ) বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

গুরুগ্রামের বাসিন্দা অঞ্জলি ডিজিটাল অ্যারেস্ট নামে সাইবার প্রতারণার শিকার হন। অভিযুক্তরা ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজেদের ভারতের আর্থিক তদারকি সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির কর্মকর্তা পরিচয় দেয় এবং তাকে ফাঁদে ফেলে।

প্রতারকরা সাধারণত ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা পরিবারের ক্ষতির হুমকি দিয়ে থাকে। এভাবেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অঞ্জলিকে টানা পাঁচ দিন ধরে ডিজিটাল অ্যারেস্টে রাখা হয়। স্কাইপ কলের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা তাকে নজরদারিতে রেখে হুমকি দেওয়া হয়, যাতে তিনি অর্থ স্থানান্তর করতে বাধ্য হন।

অঞ্জলি বলেন, এরপর আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আমি অসাড় হয়ে পড়ি। যতক্ষণে ওই ফোন কল বন্ধ হয়, ততদিনে আমি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি এবং নিজের সমস্ত সম্পত্তি খুইয়েছি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল অ্যারেস্ট জালিয়াতিতে কোটি কোটি টাকা হারিয়েছেন বহু ভারতীয়। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নথিভুক্ত হওয়া মামলার সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে এক লাখ ২৩ হাজারে পৌঁছেছে।

সাইবার জালিয়াতি এতটাই বেড়ে গেছে যে সরকারকে সংবাদপত্রে পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন, রেডিও ও টিভিতে প্রচার এবং সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত প্রায় চার হাজার স্কাইপ আইডি এবং আট হাজার ৩০০ এরও বেশি হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে।

অঞ্জলি গত এক বছর ধরে থানা ও আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তিনি তার খোয়া যাওয়া অর্থ ফেরতের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও আবেদন করেছেন।

প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের দাবি, দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতি হলেও সাইবার অপরাধ দমন ব্যবস্থা পিছিয়ে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান সাইবার জালিয়াতি, ব্যাংকগুলোর দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অর্থ ফেরত পাওয়ার জটিলতা সে কথাই বলে। সব শ্রেণির মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

অঞ্জলি বলেন, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আতঙ্কিত অবস্থায় তিনি এইচডিএফসি ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় যান। তখন ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতারকরা তার ওপর নজর রাখছিল। সেই দিনই তিনি তাদের দুই কোটি আশি লাখ টাকা দেন। পরদিন আরও তিন কোটি টাকা ট্রান্সফার করেন।

তার অভিযোগ, এত বড় অঙ্কের লেনদেন সত্ত্বেও ব্যাংক কোনও বিপদের সংকেত শনাক্ত করতে পারেনি এবং কোনও সতর্কতা জারি করেনি। যদিও লেনদেনের অঙ্কটি তার স্বাভাবিক লেনদেনের তুলনায় ২০০ গুণ বেশি ছিল।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট থেকে এত বড় অঙ্কের লেনদেন হওয়া সত্ত্বেও কেন ব্যাংকের রিলেশনশিপ ম্যানেজার কোনও কল করেননি? কেন এত বড় অঙ্কের অর্থ ডেবিট হলেও তাকে সচেতন করা হয়নি?

তিনি বলেন, মাত্র তিন দিনে এত বড় অঙ্কের লেনদেন কি সন্দেহ সৃষ্টি এবং প্রতারণা রোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না? তিনি জানান, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ৫০ হাজার টাকা খরচ করলেই ব্যাংক থেকে কল আসে যাচাইয়ের জন্য। তাহলে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা উঠলে এমনটা হবে না কেন?

এই বিষয়ে ই-মেইলে এইচডিএফসি ব্যাংক জানায়, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারা বলে, প্রতারণার বিষয়টি ব্যাংককে দুই থেকে তিন দিন পরে জানানো হয়। গ্রাহকের নির্দেশেই লেনদেন সম্পন্ন হয়, তাই কর্মকর্তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। এই ই-মেইলটি দেখা গেছে।

ব্যাংকিং ওম্বাডসম্যান এইচডিএফসির বিরুদ্ধে অভিযোগটি ২০১৭ সালের একটি নিয়ম অনুযায়ী নিষ্পত্তি করে দেন। সেই নিয়ম অনুযায়ী, যদি গ্রাহকের দোষে প্রতারণা হয়ে থাকে, তবে ক্ষতির সম্পূর্ণ দায় গ্রাহককেই নিতে হবে।

এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এইচডিএফসি ব্যাংক আর কোনও মন্তব্য করেনি। অঞ্জলি বলেন, তিনি একটা বড় চার্ট তৈরি করে দেখিয়েছেন কীভাবে তার অর্থ এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে গিয়েছিল।

ওই চার্ট অনুযায়ী, এইচডিএফসি ব্যাংক থেকে প্রথমে পীযূষ নামে এক ব্যক্তির আইসিআইসিআই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা হয়। ভারতের বড় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটি হলো আইসিআইসিআই ব্যাংক।

পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, পীযূষের অ্যাকাউন্টে আগে মাত্র কয়েক হাজার টাকা থাকলেও, অঞ্জলির টাকা সেখানে জমা হতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে তা হায়দরাবাদ ভিত্তিক ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত শ্রী পদ্মাবতী কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ১১টি অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তদন্তে আরও জানা যায়, এই ১১টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে আটটির ঠিকানা ভুয়া ছিল এবং যাদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয় তাদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অ্যাকাউন্টগুলোর কেওয়াইসি নথিও ব্যাংকে ছিল না।

বাকি তিনটি অ্যাকাউন্টের একটি ছিল এক রিকশাচালকের নামে, একটি এক বিধবা নারীর নামে যিনি বস্তিতে দর্জির কাজ করেন এবং আরেকটি এক কাঠমিস্ত্রির নামে।

পুলিশ জানতে পারে, একজন ছাড়া অন্য কেউ জানতেনই না যে তাদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এবং সেই অ্যাকাউন্ট থেকে এত বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হচ্ছে।

মে মাসে পুলিশ কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সমুদ্র ভেঙ্কটেশ্বরলুকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এখনও জেলে রয়েছেন। আদালত সাইবার জালিয়াতির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তার জামিনের আবেদন তিনবার খারিজ করেছে।

পুলিশ জানায়, এই অ্যাকাউন্টগুলোর বেশ কয়েকটি ভেঙ্কটেশ্বরলুর নির্দেশে খোলা হয় এবং এগুলো ছিল মিউল অ্যাকাউন্ট। মিউল অ্যাকাউন্ট বলতে বোঝায়—অন্যের নামে খোলা অ্যাকাউন্ট যা অপরাধীরা মানি লন্ডারিংয়ের জন্য ব্যবহার করে।

ফেডারেল ব্যাংক ও শ্রী পদ্মাবতী ব্যাংক কেউই এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। এক বছরেরও বেশি সময় পর অঞ্জলি এবং আরও কিছু ভুক্তভোগী জানুয়ারি মাসে ভারতের সর্বোচ্চ ভোক্তা আদালতে একটি পিটিশন দায়ের করেন।

আদালত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহক পরিষেবায় ঘাটতির অভিযোগ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকগুলোকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসে মামলার শুনানি হবে।

এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় বিশ্বজুড়ে বিতর্ক চলছে—এই আর্থিক ক্ষতির বোঝা বহন করবে কে? ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, না কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা?

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাজ্য এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয় এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের দায়িত্বের নিয়ম কঠোর করে। নির্দিষ্ট ধরনের প্রতারণা ছাড়া অন্য সবক্ষেত্রে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আইনজীবী মহেন্দ্র লিমা, যিনি অঞ্জলিসহ অনেক ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে লড়ছেন, বলেন, ব্যাংকের দায়িত্ব গ্রাহকদের রক্ষা করা। অস্বাভাবিক লেনদেন হলে ব্যাংকের উচিত তা আটকে দেওয়া।

তার অভিযোগ, ব্যাংকগুলো পরোক্ষভাবে ফিনান্সিয়াল সুইসাইডের জন্য দায়ী। কারণ তারা মিউল অ্যাকাউন্ট খোলা এবং গ্রাহকদের যাচাই করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং অর্থ নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছে না।

এখনও পর্যন্ত বড় কোনও স্বস্তি পাননি অঞ্জলি। তিনি মোট পাঁচ কোটি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র এক কোটি টাকা উদ্ধার করতে পেরেছেন। তার আইনজীবী জানান, এখন দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হবে।

অঞ্জলি জানান, তার সমস্যাকে আরও জটিল করেছে চুরি হওয়া অর্থের ওপর কর আদায়। বিনিয়োগ করা অর্থ উত্তোলনের সময় মূলধন লাভের ওপর কর ধার্য হয়।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.