অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায় দেশের সকল গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন করে দেশ ও জনগণের কাছে আস্থা অর্জন করুক। এ জন্যে সার্বিক সহয়তা করতে সরকার সবসময় প্রস্তুত।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রাজধানীর একটি হোটেলে বিবিসি মিডিয়া এ্যাকশনের সহযোগিতায় এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি)।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার শুরু থেকেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থ ও সুরক্ষার বিষয়ে আন্তরিক। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়েও গণমাধ্যমে সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে ঐকমত্য কমিশনের যেহেতু শুধুমাত্র নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সুপারিশ পাঠানো হয়েছে, সেই বিবেচনায় গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশগুলো সেখানে পাঠানো হয়নি।
তিনি বলেন, সরকার এর চাওয়া হচ্ছে দেশের সকল গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠতার সাথে সংবাদ পরিবেশন করবে। তবে অনেক সময়েই দেখা যায় পরিবেশিত সংবাদের সাথে বাস্তবতার কোন মিল থাকে না। এমন ধরনের সাংবাদিকতা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরী হয়।
তিনি আরো বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত প্রতিবেদনের মধ্যে যেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য তা বাস্তাবায়নে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। এই কমিটি অচিরেই বিজেসি ও খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে বলেও জানান তিনি। তবে গণমাধ্যমের সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্যে গণমাধ্যম কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিজেসির ট্রাষ্টি ফাহিম আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, ইন্টারনিউজ বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিনিধি শামীম আরা শিউলি, নিউজ নেটওয়ার্কের সিইও শাহীদুজ্জামান, সমষ্টির নির্বাহী পরিচালক মীর মাশরুজ্জমান, ডিজিটালী রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ, এমআরডিআইয়ের কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর আসিফ ইসলাম শাওন, বিজেসির ট্রাষ্টি মানস ঘোষ ও নুরে সাফা জুলহাস।
বিজেসির সদস্য সচিব ইলিয়াস হোসেন ও বিবিসি মিডিয়া এ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. আল মামুনের স্বাগত বক্তব্যে এবং ইলিয়াস হোসেন ও মাহফুজ মিশুর সঞ্চালণায় আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজেসির নির্বাহী পারভেজ রেজা।
সভাপতির বক্তব্যে বিজেসির ট্রাষ্টি ফাহিম আহমেদ বলেন, গত ১ বছরে গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের এই সদস্য হতাশা প্রকাশ করে বলেন, তাদের করা প্রতিবেদনকে এখন পর্যন্ত সরকার স্বীকৃতি দেয়নি, অবিলম্বে এটি করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে না দেয়াটা ঠিক হয়নি, সুযোগ থাকলে এটি দেয়া উচিত। প্রেস কাউন্সিল দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর থাকায় সংস্কার কমিশনে এটি বিলুপ্ত করে গণমাধ্যমসংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। তবে দেখা গেল সেই সুপারিশ আমলে না নিয়ে আবারও প্রেস কাউন্সিল কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসময় সাংবাদিকসহ যে কারও ক্ষেত্রেই সন্ত্রাস দমন আইনের প্রয়োগ বন্ধ হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইন্টারনিউজ বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিনিধি শামীম আরা শিউলি বলেন, গণমাধ্যমের সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করতে হবে যেন নির্বাচনী ইশতেহারে গণমাধ্যম সংস্কারের বিষয়টি তারা অন্তর্ভুক্ত করে।
বিজেসির ট্রাস্টি জুলহাস বলেন, নীতিমালার নামে সব সময় নিয়ন্ত্রণ মালা দেয়া হয়। কমিশন যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তার স্পিরিট ধরে রাখতে হবে আমাদের। বিগত সরকারের সময়েও এসব আলোচনা হয়েছে তবে কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি তাই আমরা বলতে চাই ডিজিটাল বাস্তবতায় মিডিয়াকে স্বাধীন সম্পাদকীয়তায় নিশ্চিত করতে না পারলে সামনে সমূহ বিপদ। সাংবাদিকদের হয় রাস্তা ছাড়তে হবে নয় রাস্তায় নামতে হবে।
নিউজ নেটওয়ার্কের সিইও শাহীদুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কোন সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া হতাশার। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবল গণমাধ্যম তৈরির সুযোগ সরকারকেই করে দিতে হবে।
ডিজিটালী রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, সব সংস্কার কখনই সরকার করে দেয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কার গণমাধ্যমের ভেতর থেকে শুরু করতে হয়। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটির অভাব রয়েছে।
আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয় যে বিধিমালা চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে সেখানে এখনও সাংবাদিকের সংজ্ঞায় সম্প্রচার গণমাধ্যমের কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আহবান জানান বিজেসিকে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (মিডিয়া) কেয়া রয় বলেন, নারী সাংবাদিকদের জন্য কর্মস্থলে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে। গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক খবর প্রকাশে জেন্ডার সংবেদনশীল নীতিমালা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
এমআরডিআই এর প্রতিনিধি আসিফ ইকবাল বলেন, সংস্কারের দুটি ভাগ রয়েছে একটি সরকার করে দেবে। সাংবাদিকদের নিজেদের উন্নয়ন নিজেদেরই করতে হবে। সরকারকে প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সবাই মিলে চাপ দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যতটুকু সম্ভব কাজ করে যাবেন পরবর্তী সরকার এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করবেন। এ সকল আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোকেও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.