স্ত্রীর গায়ের রং কালো, জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অপরাধে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

স্ত্রীর গায়ের রং কালো বলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অপরাধে ভারতে এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুর আগে স্ত্রী লক্ষ্মী বলেছিলেন, তাঁর স্বামী কিষাণদাস তাঁকে সব সময় ‘কালি’ বলে রাগাতেন।

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রাহুল চৌধুরী এই রায়ের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, এই খুনটা ‘সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের’ মধ্যে পড়ে। পৃথিবীতে এমন ঘটনা খুবই বিরল। এটি শুধু একটা খুন নয়, এটা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’।

বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিষাণদাসের আইনজীবী দাবি করেন, তাঁর মক্কেল নির্দোষ। তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

আট বছর আগে লক্ষ্মীকে খুন করা হয়েছিল। সম্প্রতি এই মামলার রায় দেওয়া হয়। এই ঘটনাটি এমন একটি দেশে খবরের শিরোনাম হয়েছে, যেখানে মানুষের মধ্যে ফর্সা গায়ের রঙের প্রতি ঝোঁক খুবই বেশি।

আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৪ জুন রাতে লক্ষ্মীর ওপর হামলা চালানো হয়। লক্ষ্মী তাঁর মৃত্যুর আগে পুলিশ, চিকিৎসক ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কিছু কথা বলেছিলেন।

লক্ষ্মী বলেছিলেন, ২০১৬ সালে বিয়ের পর থেকে তাঁর স্বামী তাঁকে প্রায়ই ‘কালি’ বলে ডাকতেন এবং তার শরীর নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতেন।

যে রাতে লক্ষ্মীর মৃত্যু হয়, সেই রাতে কিষাণদাস বাদামি রঙের একটা তরল ভরা বোতল এনেছিলেন। ওই বোতল দেখিয়ে তিনি লক্ষ্মীকে বলেছিলেন, এটা তাঁর ত্বক ফর্সা করার ওষুধ।

লক্ষ্মীর ভাষ্য অনুযায়ী, কিষাণদাস সেই তরলটা তার শরীরে মাখিয়ে দেন। লক্ষ্মী যখন তাঁর স্বামীকে বলেন, এটার গন্ধ অ্যাসিডের মতো, তখন কিষাণদাস একটা ধূপকাঠি দিয়ে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। যখন তাঁর শরীর জ্বলতে শুরু করে, তখন তিনি বাকি তরলটুকু লক্ষ্মীর গায়ে ঢেলে দিয়ে পালিয়ে যান।

কিষাণদাসের মা-বাবা এবং বোন লক্ষ্মীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

বিচারক চৌধুরী তাঁর রায়ে বলেন, ‘এটা বলা ভুল হবে না যে এই জঘন্য অপরাধটা কেবল লক্ষ্মী নয়, এটি পুরো মানবজাতির বিরুদ্ধে একটা অপরাধ।’

বিচারক আরও বলেন, কিষাণদাস লক্ষ্মীর বিশ্বাস ভেঙেছেন এবং যখন তাঁর শরীরে আগুন জ্বলছিল, তখন বাকি তরলটুকু গায়ে ঢেলে তিনি চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন।

আদেশে আরও বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের অপরাধ কোনো সুস্থ সমাজে কল্পনা করা যায় না। এটা মানবতাকে লজ্জাকর।’

সরকারি আইনজীবী দীনেশ পালিওয়াল এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, তিনি আশা করেন এই রায় সমাজের অন্য মানুষের জন্য ‘একটা শিক্ষা’ হবে।

আইনজীবী দীনেশ প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘২০ বছর বয়সী একটা মেয়েকে খুব নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে। সে তো কারও বোন ছিল, কারও মেয়ে ছিল, কিছু মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। আমরা যদি আমাদের মেয়েদের রক্ষা না করি, তাহলে কে রক্ষা করবে?’

দীনেশ আরও বলেন, তিনি হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য আদেশটি পাঠিয়েছেন। তবে, আসামি ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন।

কিষাণদাসের আইনজীবী সুরেন্দ্র কুমার মেনারিয়া বিবিসিকে বলেন, লক্ষ্মীর মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা ছিল। তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কোনো প্রমাণ নেই। তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।

উদয়পুরের এই রায়ে আবারও ভারতে ফর্সা ত্বকের মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

কালো গায়ের রঙের মেয়েদের এবং নারীদের হেয় করে কথা বলা হয় এবং তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। এখানে ত্বক ফর্সা হওয়ার ক্রিম অনেক লাভজনক ব্যবসা, যা থেকে শত শত কোটি ডলার আয় হয়।

বিয়েসংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে প্রায় সব সময় গায়ের রঙের কথা বলা হয় এবং ফর্সা গায়ের রঙের পাত্রীর চাহিদা বেশি থাকে।

অতীতে বিবিসিসহ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন অনেক ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে স্বামীরা ‘গায়ের রং কালো’ বলে কটূক্তি করায় নারীরা আত্মহত্যা করেছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কিছু মানুষ গায়ের রং নিয়ে এমন ধ্যান–ধারণার বিরুদ্ধে কাজ করছেন। কিন্তু তাঁরা বলেন, মানুষের এই পুরোনো ধারণাগুলো পাল্টানো খুব কঠিন।

যত দিন এই ধরনের ভাবনা না পাল্টাবে, তত দিন এমন বৈষম্যমূলক আচরণ মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দেবে।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.