বিশ্ববাজারে সোনার নতুন রেকর্ড দাম

গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে সোনার দাম নতুন রেকর্ড গড়েছে। এদিন সকালে সোনার আউন্সপ্রতি দাম বেড়ে ৩ হাজার ৫০০ ডলার অতিক্রম করেছে। মার্কিন ডলারের দুর্বলতা ও চলতি সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাবে—এমন প্রত্যাশা থেকে সোনার প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। সে কারণেই পণ্যটির দাম বেড়েছে।

মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়ে ৩ হাজার ৫০৮ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলারে ওঠে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত সোনার দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

ক্যাপিটাল ডটকমের আর্থিক বাজার বিশ্লেষক কাইল রড্ডা বলেন, দুর্বল অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার কমানোর সম্ভাবনা সোনাসহ মূল্যবান ধাতুর বাজার চাঙা করে তুলছে। তাঁর ভাষায়, আরেকটি কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ, তথা ফেডের স্বাধীনতায় সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে ডলারভিত্তিক সম্পদে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। খবর রয়টার্সের

মাসের পর মাস ধরে ট্রাম্প ফেড ও এর চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের সমালোচনা করছেন। ট্রাম্পের মূল অভিযোগ, পাওয়েল সুদহার কমাচ্ছেন না। সম্প্রতি তিনি আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়াশিংটন সদর দপ্তরের ব্যয়বহুল সংস্কারকাজ নিয়েও পাওয়েলের সমালোচনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সোমবার রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ফেড স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল এবং থাকা উচিতও। কিন্তু ফেড অনেক ভুল করেছে। পাশাপাশি তিনি ট্রাম্পের পক্ষ নিয়ে দাবি করেন, বন্ধকির বিষয় নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে ফেড গভর্নর লিসা কুককে বরখাস্ত করার অধিকার প্রেসিডেন্টের রয়েছে।

সিএমই ফেডওয়াচ টুল অনুযায়ী, ব্যবসায়ীরা এখন ধরে নিচ্ছেন, ১৭ সেপ্টেম্বর ফেডের এক-চতুর্থাংশ শতাংশ পয়েন্ট সুদহার কমানোর সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সোনায় বিনিয়োগ করে সুদ পাওয়া যায় না ঠিক, কিন্তু সুদের হার কম থাকলে সোনার মতো সুদবিহীন সম্পদ বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে; অর্থাৎ সুদহার কমলে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে।

সুদহার কমানোর প্রত্যাশা ও ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তার কারণে মার্কিন ডলার চাপের মুখে পড়েছে। বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ডলারের দাম দেড় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানের কাছাকাছি। এতে বিদেশি ক্রেতাদের জন্য সোনা তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে গেছে।

ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নির্ভরযোগ্য নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনার কদর দীর্ঘদিনের। ২০২৫ সালে একাধিক রেকর্ড ভেঙে সোনার দামে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ডলারভিত্তিক সম্পদ থেকে সরে আসা ও সোনার মজুত বাড়ানো, ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তায় নিরাপদ সম্পদের চাহিদা ও ডলারের সার্বিক দুর্বলতা—এসব মিলিয়েই সোনার দামে উত্থান ত্বরান্বিত হয়েছে।

২০২৪ সালে সোনার দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ মাসে ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তখনই প্রথমবার আউন্সপ্রতি দাম তিন হাজার ডলার অতিক্রম করে।

কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজারবিশ্লেষক টিম ওয়াটারার বলেন, যদি ফেড একাধিকবার সুদহার কমায় এবং রাশিয়া–ইউক্রেন শান্তিচুক্তি অধরাই থেকে যায়, তাহলে সোনার দামের এই দৌড় অব্যাহত থাকবে। বছরের শেষ নাগাদ প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩ হাজার ৬০০ ডলার অতিক্রম করতে পারে।

কেন সোনার দাম বাড়ে-কমে

অন্য সব পণ্যের মতো সোনার দরও সরবরাহ এবং চাহিদার ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। সরবরাহ হয় দুইভাবে—নতুন করে উত্তোলন ও পুরোনো সোনা বিক্রি। স্বর্ণখনিতে সোনা উত্তোলন চলমান প্রক্রিয়া। সাধারণত প্রতিবছর কত পরিমাণ সোনা উত্তোলন করা হবে, তার একটা হিসাব পাওয়া যায়। এই হিসাবে খুব একটা ওঠানামা করে না। যেমন মহামারির বছর ২০২০ সালেও সোনা উত্তোলন করা হয়েছিল আগের বছরগুলোর মতোই—৩ হাজার ৪৭৬ টন। তবে সাধারণত সোনার সরবরাহ বাড়ে মূল্যবৃদ্ধির সময়। দাম বাড়লে অনেকেই হাতে থাকা সোনা বেশি মুনাফার আশায় বিক্রি করে দেন, অনেকে আবার জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয় মেটাতেও সোনা বিক্রি করেন।

সোনার চাহিদাও তৈরি হয় দুইভাবে। যেমন গয়নার চাহিদা ও সোনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়না হিসেবে সোনা বেশি ব্যবহৃত হয় চীন ও ভারতে। পশ্চিমা দেশগুলোতেও গয়নার ভালো চাহিদা আছে। আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, সরবরাহ করা মোট সোনার ৪৭ শতাংশই ব্যবহার করা হয় গয়নায়, এর পরিমাণ ২ হাজার টনের বেশি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতে এখনো চলতি বছরের সোনা বিক্রির মৌসুম শুরু হয়নি। এখন বড় কোনো উৎসব নেই। বিয়ের মৌসুমও শুরু হয়নি। এই মৌসুম শুরু হবে নভেম্বর থেকে। সে সময়েই সোনার চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।

এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে সোনায় বিনিয়োগ করার জন্য বন্ডসহ নানা ধরনের আর্থিক সম্পদ আছে। অনিশ্চয়তার সময় এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ভবিষ্যতের জন্য সোনার মজুত বাড়িয়ে দেয়। হিসাব অনুযায়ী, সোনার বার ও সোনার মুদ্রায় বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার টন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

বিশ্ববাজারে সোনার দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ প্রবণতা বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সেন্ট্রাল ব্যাংক গোল্ড রিজার্ভ সার্ভে ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণভান্ডার বৃদ্ধি করতে আগ্রহী।

সেই সঙ্গে জরিপে আরও জানা গেছে, ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, আগামী ১২ মাসের জন্য পর্যাপ্ত সোনা মজুত আছে তাদের কোষাগারে। বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রা ডলারকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় অনেক দেশ এখন ডলারের বিকল্প খুঁজছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা বেড়েছে।

এদিকে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি এখন আগামী শুক্রবার প্রকাশিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের অকৃষি খাতের মজুরির পরিসংখ্যানের দিকে। কারণ, এ মাসের শেষ দিকে ফেড কতটা সুদহার কমাতে পারে, তা নির্ভর করছে এর ওপর।

অন্যদিকে গতকাল রুপার দাম ছিল প্রায় অপরিবর্তিত, আউন্সপ্রতি ৪০ দশমিক ৬৪ ডলার। ইতিপূর্বে রুপার দাম অবশ্য সেপ্টেম্বর ২০১১–এর পর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.