ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ আজ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। বুধবার (২৭ আগস্ট) নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচনি কাজের সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করবে ইসি।
সচিব বলেন, আমাদের এটার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। এটা আমরা বুঝি। আপনারা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এর আগে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাউসদ বলেন, কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ অনুমোদন দিয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে।
হিসাব অনুযায়ী, সংসদ ভোটের জন্য ইসির হাতে সময় আছে আর মাত্র ৫ মাস। ফলে আইন অনুযায়ী ভোটের ৫০-৬০ দিন আগে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করে সব ধরনের প্রস্তুতি নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকবে এই রোডম্যাপে। ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হবে। আর তফসিল হবে তার দুই মাস আগে। এ ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল হতে পারে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ভোটের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু করেছে কমিশন। তার অংশ হিসেবে ভোটার হালনাগাদ, প্রশিক্ষণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত, ম্যানুয়্যাল প্রস্তুত, আইন সংস্কার, ভোটের উপকরণ ক্রয়সহ ২৪ ধরনের বিষয় রোডম্যাপে স্থান পাবে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে (রমজানের আগে) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট এবং ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় ধরেই দুই ডজনের বেশি প্রস্তুতিমূলক কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে অংশীজনদের সঙ্গে নির্বাচনি সংলাপ করার প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। আর নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে সংসদীয় ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে ৩৩ জেলার ৮২টি আসনের দাবি-আপত্তির ওপর শুনানি শেষ করেছে।
ইসির একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য সংসদ নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনি রোডম্যাপেও ইসির প্রস্তুতিমূলক কর্মপরিকল্পনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অন্তত ১৫ ধরনের কার্যক্রম। সেগুলো হলোÑসম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ, নির্বাচনি আইনের সংস্কার, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ, নির্বাচনিবিধি ও নীতিমালা জারি, প্রবাসীদের ভোট, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত, ব্যালট মুদ্রণ, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সভা ও ভোটার সচেতনতামূলক কার্যক্রম। একই সঙ্গে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন অন্তত ৭টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন। সেগুলো হলোÑনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, ভোটারদের আস্থায় আনা ও ভোটের দিন কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, অপপ্রচার ও এআইয়ের ব্যবহার মোকাবিলা, প্রার্থীদের আচরণবিধি মানানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও মাঠে দায়িত্বরতদের নিরপেক্ষতা এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমুক্ত রাখা।
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ আগামী ৩০ নভেম্বর : আগামী পহেলা নভেম্বর প্রকাশ করা হতে পারে চূড়ান্ত সম্পূরক ভোটার তালিকা। এরপর ৩০ নভেম্বর প্রকাশ হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা। কর্মপরিকল্পনায় এমন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি সূত্রগুলো। সেই লক্ষ্যে হালনাগাদের পর খসড়া ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হবে ৩১ আগস্ট। আর সম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে অক্টোবরে। ৩১ অক্টোবর ভোটারযোগ্য তরুণদেরও জাতীয় নির্বাচনের সুযোগ দিতে আরও একটি সম্পূরক তালিকা করা হবে। আর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। এ ছাড়া প্রবাসী ভোটারদের জন্য প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার দিতে অনলাইন নিবন্ধন অ্যাপ ও পোস্টাল ব্যালটের বিষয়টি নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রবাসীদের জন্য আইটি সাপোর্টেড নিবন্ধন ও পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি প্রক্রিয়াধীন, চূড়ান্ত হলে পদ্ধতি নিয়ে প্রচারণা। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করা হয়। যেহেতু নভেম্বরের একেবারে শেষে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হবে। তাই তফসিল তার কিছু দিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হতে পারে।
চার দিনে ৮৪টি আসনের ১ হাজার ৮৯৩ শুনানি শেষ করেছে ইসি। দ্রুত চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত খসড়া নিয়ে ইসি আয়োজিত শুনানি শেষ হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের উপস্থিতিতে গত ২৩ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত চার দিনে ৮৪টি সংসদীয় আসনের এক হাজার ৮৯৩টি আবেদনের শুনানি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। বুধবার ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ২৪ আগস্ট থেকে চার দিন সংসদীয় আসনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সময়ে ৩৩টি জেলার ৮৪টি আসনে মোট এক হাজার ৮৯৩টি আবেদনের শুনানি করা হয়। গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৮৩টি আসনের সীমানা নিয়ে এক হাজার ৭৬০টি দাবি-আপত্তি জমা পড়ে ইসিতে। এগুলোই নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি।
আগামী সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ ইসির : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রোডম্যাপ অনুমোদন করেছে ইসি। আজ রোডম্যাপ প্রকাশ করতে পারে ইসি। জানা যায়, আগামী সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে অংশীজনদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শুরু হবে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হবে। আর তফসিল হবে তার দুই মাস আগে।
ছোটোখাটোসহ ৪৪টি বিষয়ে আরপিও সংস্কার চূড়ান্তের পর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ছোটখাটোসহ অন্তত ৪৪টি বিষয়ে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব। রাজনৈতিক দল ও আচরণবিধি অনুমোদিত আরপিও সংস্কার সাপেক্ষে জারি হবে।
এদিকে অক্টোবরের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কার, আচরণবিধিমালা জারি, ভোটার তালিকাসহ সব কিছু চূড়ান্ত করবে ইসি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট নিতে প্রয়োজনীয় অ্যাপসহ আনুষঙ্গিক কাজ এবং তরুণ ভোটারদের নিয়ে সম্পূরক ভোটার তালিকার কাজ নভেম্বরে শেষ করতে চায় ইসি। নতুন দলের নিবন্ধন বাছাই শেষে বাদ পড়েছে ১২১টি আবেদন। বাছাইয়ে টিকে থাকা ২২টি দলের অস্তিত্ব, কার্যকারিতা মাঠপর্যায়ে তদন্ত চলছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এবার অন্তত ৩১৮টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার আবেদন বাছাই করছে ইসির কমিটি। অক্টোবর-নভেম্বরে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ব্রিফিং, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা, পোস্টাল ব্যালট নিয়ে কার্যক্রম, ম্যানুয়াল ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা মুদ্রণ, ভোটকেন্দ্রের সম্ভাব্য তালিকা ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা সরবরাহ, বিতরণের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
এবার ভোটের সময় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের আগে এবার সাড়ে ১১ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৯ আগস্ট কোর ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, যা চলবে প্রায় ৫ মাস। এ সময়ে প্রায় ১১ হাজার (১০৮৫০) জন রাজনৈতিক কর্মীকে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেবে ইসি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা তাদের দলীয় পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব-কর্তব্য, ভোটগ্রহণের নিয়ম-কানুন এবং আইন ও বিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবেন। এবার নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার, সহাকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার মিলিয়ে প্রায় সোয়া ৯ লাখের মতো লোকবল দরকার হতে পারে আগামী সংসদ নির্বাচনে।
এ বিষয়ে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, সবমিলিয়ে এবার ২৩ ধরনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে ইটিআই। এর আওতায় ১১ লাখ ৬৮ হাজার ব্যক্তিকে ট্রেনিং দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে আছেন ১০ লাখ ৮৯ হাজার প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং এবং পোলিং কর্মকর্তা। নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র হতে পারে, এমনটা ধরে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমে এলে প্রশিক্ষণার্থী ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও কমবে। এ ছাড়া যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ছাড়া সাংবাদিক ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও রয়েছে তাদেরও দিনব্যাপী নির্বাচনি প্রশিক্ষণ দেবে কমিশন। যদিও ওই প্রশিক্ষণের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওরিয়েন্টেশন বা ব্রিফিং’। কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ে পৃথকভাবে এসব প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.