দেশ সংস্কারে ইউনূসের সুযোগ ছিল, কিন্তু কাজে লাগাননি: রেহমান সোবহান

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উচিত ছিল কিছু নির্দিষ্ট সংস্কার এজেন্ডায় নিজের কর্তৃত্ব কাজে লাগানো। অন্তত তিনি সেগুলো বাস্তবিকভাবে শুরু করে পরবর্তী সরকারের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যেতে পারতেন।

আন্তর্জাতিক পরিসরে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ছিল, ফলে তাঁর হাতে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি বা তাঁর সরকার সে পথে অগ্রসর হননি বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান।

শনিবার (২৩ আগস্ট) রাতে সমাজ গবেষণাকেন্দ্রের আয়োজনে ‘অর্থনৈতিক সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি: প্রতিশ্রুতি, প্রতিবন্ধকতা, বাস্তবতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় জুম প্ল্যাটফর্মে তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান।

রেহমান সোবহান বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়া এখন এসে পড়েছে নাগরিক সমাজের ছোট একটি গোষ্ঠীর কাঁধে। ভিন্ন ভিন্ন ১০টি কমিশন থেকে আসা সংস্কার প্রস্তাব একত্র করার কঠিন কাজটি নাগরিক সমাজের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, এসব কমিশনের কার্যপরিধি নির্ধারিত ছিল না, ফলে প্রস্তাবগুলোতে সমন্বয় বা সংহতির অভাব ছিল। একই সঙ্গে সংস্কার প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকারের ধারাবাহিকতা বা আদর্শিক ভিত্তি অনুপস্থিত ছিল।

প্রতিটি কমিশন নিজের খাত নিয়ে আলাদা ভাবনা-চিন্তা করেছে, আর তুলনামূলকভাবে ছোট একটি গোষ্ঠীর ওপর এসে পড়েছে বড় রাজনৈতিক কাজ—প্রায় ১০০ রাজনৈতিক দলকে বসিয়ে সংস্কার নিয়ে সমঝোতায় আসার দায়িত্ব।

বর্তমানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে, যার মেয়াদ আরও ছয় মাস। এরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রেহমান সোবহান বলেন, এখন আলোচনার মূল বিষয় হওয়া উচিত—এই ছয় মাসে সরকার কী করবে এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে।

আলোচনার বিশেষ অতিথি ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন এশীয় প্রবৃদ্ধি ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম।

আলোচনার মূল প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের আগ্রহ কম। আর যারা সংস্কার চান, তাদের ক্ষমতা কম। এর বিপরীতে সংস্কারবিরোধী শক্তি অনেক বেশি প্রভাবশালী, যা বিশেষ করে ব্যাংক ও রাজস্ব খাতে দৃশ্যমান হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কারের বড় আশা তৈরি হয়েছিল, তবে এখন পর্যন্ত সেই সফলতা বেশ ভঙ্গুর। সবচেয়ে বেশি সংস্কার হয়েছে ব্যাংকিং খাতে, তবে ভবিষ্যতে তা টিকে থাকবে কি না, তা অনিশ্চিত।

ভবিষ্যতের করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের স্বকীয়তা বা স্টেট অটোনমি বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার নিয়ে আগ্রহী হতে হবে, এবং আমলাতন্ত্রকে আরও পেশাদারভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সংস্কার শব্দের ভেতর অনেক কিছু চাপা পড়ে যায়। এখন মূল সমস্যা হলো, কী করা যাবে আর কী নয়—তা নির্ধারণ করছেন আমলারা। অলিগার্কি নয়, বরং ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় ‘নেক্সাস’ গড়ে উঠেছে, যেখানে সুশীল সমাজও জড়িত।

তিনি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ এখন থমকে আছে দক্ষ মানবসম্পদ, নতুন প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অভাবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, অর্থনৈতিক সূচকের উন্নতি মানেই সংস্কার নয়, তা হলো সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার অংশ। প্রকৃত সংস্কার বলতে বৈষম্য হ্রাস ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধিকে বোঝায়।

তিনি বলেন, গত এক বছরে বিনিয়োগ, মজুরি বা কর্মসংস্থান বাড়েনি। তাই সংস্কার করতে হলে কৃষি ও শিল্প খাতভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান এম এম আকাশ বলেন, সংস্কার নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেই। যে পদক্ষেপগুলো রয়েছে, সেগুলোর স্থায়িত্ব নিয়েও সন্দেহ আছে।

তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকারের বড় ব্যর্থতা শিক্ষাখাতকে উপেক্ষা করা। তবে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সংস্কার বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ পথ তৈরি হতে পারে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন বিশ্বব্যাংক ও আইএফসির সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ আখতার মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল প্রমুখ।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.