রাশিয়ার অর্থপ্রবাহ বন্ধে ট্রাম্পের শুল্ক হুঁশিয়ারিতে বাড়ছে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার মুখে থেকেও জ্বালানিসম্পদের ওপর নির্ভর করে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এই অর্থপ্রবাহ বন্ধে এবার কড়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করা দেশগুলোর পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র শতভাগ পরোক্ষ শুল্ক আরোপ করবে। এর মানে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত দেশগুলো থেকে আমদানি করা যেকোনো পণ্যের দাম মার্কিন বাজারে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির সরবরাহ কমে যাবে, ফলে বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি। ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের কিয়ারান টমকিনস বলেন, রাশিয়ার তেল-গ্যাস কেনে এমন দেশগুলোতে শুল্ক আরোপ বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বাড়াবে।

রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেশটির জ্বালানি রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে। আর যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনে জ্বালানি খাত থেকে পাওয়া রাজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ট্রাম্প বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন রেকর্ড পরিমাণে তেল উৎপাদিত হচ্ছে, ফলে মূল্যস্ফীতির ভয় তাঁর নেই। তবে ২০২২ সালের মতো পরিস্থিতি যাতে আবার তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে সতর্ক থাকছে বিশ্লেষকেরা।

‘শ্যাডো ফ্লিট’ দিয়ে নিষেধাজ্ঞা এড়াচ্ছে রাশিয়া
রাশিয়া একাধিক ট্যাংকার ও মালিকানাবিহীন জাহাজের মাধ্যমে একটি ছায়া নৌবহর গড়ে তুলেছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘শ্যাডো ফ্লিট’। এর মাধ্যমে রপ্তানি কার্যক্রম গোপন রেখে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাচ্ছে মস্কো।

নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নেফিউ বলেন, “নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ টার্গেট দেশগুলো তা এড়াতে সচেষ্ট থাকে।”

ভারতের আইফোনে দ্বিগুণ শুল্ক?
২০২২ সালে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ক্রেতা হয়ে ওঠে ভারত। ট্রাম্প বলেছেন, ভারত যুদ্ধযন্ত্রে জ্বালানি জোগাচ্ছে—এটা মেনে নেওয়া যায় না।

ফলে যদি এই পরোক্ষ শুল্ক কার্যকর হয়, তাহলে ভারতীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে। এতে আইফোনসহ নানা পণ্যের দাম দ্বিগুণ হতে পারে। কারণ অ্যাপল এখন ভারতেই আইফোন উৎপাদন করে আমেরিকায় রপ্তানি করছে।

ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানির কাঁচামাল ও সার আমদানি করছে—২০২৪ সালে যার পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তাই এই পদক্ষেপকে ‘দ্বিমুখী নীতি’ বলে আখ্যায়িত করেছে ভারত।

চীন ও ইউরোপের ওপর প্রভাব
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি ক্রেতা চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে প্রতিবছর ভারতের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি পণ্য আমদানি করে। ফলে চীনা পণ্যে একই ধরনের শুল্ক আরোপ করা আরও জটিল হয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞ সাইমন ইভেনেট বলেন, “চীন এতে প্রভাবিত হবে না; বরং দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্ক এখনো রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি করছে। যদিও ইইউ বলেছে, ২০২৭ সালের মধ্যে এই আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করবে।

তবে ইউরোপীয় পণ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্র ১০০ শতাংশ শুল্ক দেয়, তাহলে ওষুধ ও যন্ত্রপাতির মতো পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে এবং মার্কিন ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে।

রাশিয়ার অর্থনীতি কোথায় দাঁড়াচ্ছে?
২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৩ শতাংশ। তবে দেশটির অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেতনিকভ স্বীকার করেছেন, দেশটি এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে।

আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ০.৯ শতাংশ। দেশটির মোট বাজেট ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানি খাত থেকে। তবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় এখন জিডিপির ৬.৩ শতাংশ—স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সর্বোচ্চ।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ চালাতে তাদের জিডিপির ২৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করছে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া দেশটির পক্ষে টিকে থাকা কঠিন।

এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা দুর্বল করে যুদ্ধ থামানো এবং ইউক্রেনকে টিকিয়ে রাখা।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.