আজ ৫ আগস্ট। ইতিহাস পাল্টে দেয়া ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’। টানা ৩৬ দিনের সংগ্রামে পতন হয় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন। ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণবিস্ফোরণে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
কিন্তু যাদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই শহীদদের যথাযথ সম্মান ও মর্যদা দেওয়া হচ্ছে না। এক বছরে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ নির্ভুল তালিকা হয়নি। তাদের সংখ্যা নিয়ে সরকার এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে গরমিল রয়েছে। এছাড়াও শুরুতে নির্ভুল তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্তমানে তা গতিহীন হয়ে পড়েছে। তাদের কবরগুলোও সংরক্ষণে তেমন উদ্যোগ নেই। এতে অনেক শহীদের নাম হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের শেষ সময়ে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে গণকবরে ১১৪ জনের লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এছাড়াও অভ্যুত্থানে শহীদ ছয়জনের লাশ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। এগুলো শনাক্তে কার্যকর উদ্যোগ নেই। শহীদদের ব্যাপারে উদ্যোগ শুধু কথাতে ও কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের তালিকা দুই দফায় প্রকাশ করে সরকার। সরকারি ওয়েবসাইটে দেওয়া গেজেট অনুযায়ী, প্রথম দফায় এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত তালিকায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদের সংখ্যা ছিল ৮৩৪। পরে আবার এ বছরের ৩০ জুন আরও ১০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু গত ২ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের তালিকা থেকে ৮ জনের নাম বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, গেজেটে চারজনের দুবার নাম এসেছে এবং বাকি চারজন সরাসরি জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন না। যার কারণে তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। সেই হিসাবে সরকারি গেজেট অনুযায়ী, ২ আগস্ট পর্যন্ত শহিদের সংখ্যা ছিল ৮৪৪। ৮ জন বাদ দেওয়ার পর নতুন গেজেট অনুযায়ী শহিদের সংখ্যা ৮৩৬। শহিদদের নামের সঙ্গে গেজেট নম্বর, মেডিকেল কেস আইডি, বাবা-মায়ের নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, জেলা ও বিভাগ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে এখন জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যায় তালিকায় ৮৪৫ জনের নাম দেখানো হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শহিদের তালিকায় ৮৩৪ জনের নাম রয়েছে।
ভারতের সমর্থনে দেশের ওপর টানা ১৬ বছর চেপে বসে ছিল ভয়ংকর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠে ছাত্র-জনতা। আন্দোলনটা কোটা দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতনে গিয়ে থামে। তবে আন্দোলন দমাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালায় হাসিনা। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়, এক হাজার ৪০০ নিরস্ত্র মানুষ। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৫ হাজার। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এই নৃশংস পথ বেছে নেয় হাসিনা। এরপর প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে শুরুতে শহীদদের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অন্যান্য ইস্যুর আড়ালে শহীদরা হারিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজয় ১৯৭১ সালে। ওই সময়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। স্বাধীনতার পর শহীদদের তালিকা করার জোরালো দাবি উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি আছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনায় এক হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। শতকরা হিসাবে যা ১২-১৩ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুসারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জনকে শহীদ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, তালিকা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তবে এ পর্যন্ত যাদের শহীদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা অর্থসহায়তা, মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা এবং এক হাজার ৩৫৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে তা এখনও সিদ্ধান্তই রয়ে গেছে।
সরকারের গেজেট অনুসারে এ পর্যন্ত শনাক্ত করা শহীদের সংখ্যা ৮৪৪। কিন্তু জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৮২০। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট সংখ্যায় মিল নেই। এই ফাউন্ডেশনে তথ্যে আহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১১ হাজার ৮৫০ জন। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং বলছে শহীদের সংখ্যা ১৪শ।
শহীদ পরিবারের অনেকেই অভিযোগ করেন, তাদের জন্য অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। সরকারি সহায়তা তুলতে গেলে যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা বলে বুঝানো যাবে না বলে তারা মন্তব্য করেন।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.