কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে তা ১০-২০ শতাংশে সীমিত থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ‘লিবারেশন ডে’ শুল্কের ওপর ৯০ দিনের বিরতির সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই। তার আগে হোয়াইট হাউসকে খুশি করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানি। খবর বিবিসি।
এরইমধ্যে শুক্রবার ট্রাম্প জানিয়েছেন, ১ আগস্ট থেকে নতুন হারে শুল্ক কার্যকর হবে। তার আগে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের বার্তা দিয়ে ১২টি দেশের উদ্দেশে চিঠি পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তবে কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে তা ১০-২০ শতাংশে সীমিত থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। কোন দেশগুলো এই চিঠি পাবে, তা তিনি বলেননি।
ট্রাম্পের এই অনিশ্চিত পরিকল্পনায় কোম্পানিগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বাজার। ব্লুমবার্গ সম্প্রতি জানিয়েছে, হোয়াইট হাউস পরিকল্পনা করছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপ সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে। কারণ এসব অঞ্চল দিয়ে চীন এআই প্রযুক্তিতে চোরাকারবারি করছে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।
চিপ, বস্ত্র ও গাড়ি শিল্পের কোম্পানিগুলো এশিয়ায় ছড়িয়ে থাকা তাদের জটিল সরবরাহ চেইন পুনর্বিন্যাসে বাধ্য হচ্ছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের অপর্না ভারতদ্বাজ বলেন, ‘এখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প মজুত গড়তে হচ্ছে, ইনভেন্টরি বাড়াতে হচ্ছে, লিড টাইম দীর্ঘ করতে হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তেমনি প্রতিযোগিতা ও বাজার দখলের ঝুঁকিও বাড়ছে।’
২০২৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির ৭ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রেখেছে। তবে এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ট্যারিফের কারণে তাদের বস্ত্র, আসবাব, রাবার ও প্লাস্টিক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে যা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ নয়।”
এই অঞ্চলে শুধু ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। সেখানে আমদানি পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে, তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানিকৃত পণ্যে কোনো শুল্ক আরোপ হবে না। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে জাপানকে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ শুল্কের হুমকি দিয়েছেন। মাজদা সহ জাপানি গাড়ি নির্মাতারা বলছে, তাদের এখন বাঁচার লড়াই করতে হচ্ছে, কারণ নতুন সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া ও উৎপাদন ব্যবস্থা বদলাতে বিপুল সময় ও অর্থ অর্থ ব্যয় হয়।
মার্কিন নিরাপত্তার অন্যতম অংশীদার অস্ট্রেলিয়াও বাদ যায়নি ট্রাম্পের শুল্কনীতি থেকে। এই পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড মার্কিন পণ্য আমদানি বাড়াতে চাচ্ছে। সেইসঙ্গে আমেরিকান পণ্যের ওপরও শুল্ক কমাতে চাচ্ছে। কিন্তু কম্বোডিয়ার মতো দরিদ্র দেশগুলোর আমদানি বাড়ানোর সক্ষমতা নেই। দেশটির ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক হার নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এশীয় অর্থনীতিগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ের উপর নির্ভরশীল। সরবরাহ চেইনের বিন্যাস বদলে গেলে তাদের জন্য তা সামলানো খুব কঠিন হবে। ভারতের মতো যেসব দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশি তারা হয়তো ধাক্কা সামাল দিতে পারবে। কিন্তু সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও চীনের মতো রফতানিনির্ভর অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
ট্রাম্প প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া চিপ ও ডেটা সেন্টার খাতে বড় বিনিয়োগ শুরু করে। এটি ছিল তথাকথিত ‘ফ্রেন্ড-শোরিং’ কৌশলের অংশ—যেখানে মার্কিন বন্ধু রাষ্ট্রে উৎপাদন স্থানান্তর করা হয়। এর পাশাপাশি ‘চায়না + ১’ কৌশলে বহু কোম্পানি সরবরাহ চেইন চীন ও তাইওয়ান ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার করেছে। এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত রাখে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে সেই বাজারে প্রবেশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ এখন ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া থেকে সরে শুল্ক হারে সুবিধাজনক ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে যেতে পারে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার বাজারও বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শিল্পে এখন আর বিশ্বায়নের যুগ নেই, বরং ‘আঞ্চলিকায়ন’ চলছে বলে অভিমত অনেক বিশ্লেষকের। যেখানে নিরাপদ মনে হয় যেখানে সরবরাহ বজায় থাকবে, সেখানেই বাজার টিকে থাকবে। আর এই কারণেই ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠছে একটি অনিশ্চিত বাণিজ্যসঙ্গী। তবে এ অবস্থায় চীন বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন রক্ষকের ভূমিকায় উঠে আসছে বলে মনে করেন তারা। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের ট্যারিফ দুইটি বৈশ্বিক ধারা জোরদার করছে—চীন ও পশ্চিমের মধ্যে বাণিজ্য হ্রাস, আর চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.