শুকিয়ে যাচ্ছে সাগর, দেখা যায় খালি চোখেও

শৈশবে আদিলবেক কোজিবাকভের মা ফ্রিজে সব সময় একটি কৌটায় ক্যাভিয়ার (স্টারজন মাছের ডিম) রাখতেন। প্রতিদিন রুটি আর মাখনের ওপর এক চামচ করে ক্যাভিয়ার দিয়ে কোজিবাকভ আর তাঁর ভাইবোনদের খাওয়াতেন। মা বিশ্বাস করতেন, ক্যাভিয়ার তাঁদের স্বাস্থ্য ভালো রাখবে।

রবিবার (২৯ জুন) সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

কোজিবাকভের বয়স এখন ৫১ বছর। তিনি একজন বাস্তুতন্ত্রবিদ। বড় হয়েছেন পশ্চিম কাজাখস্তানের আকতাউ শহরে। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে শহরটির অবস্থান।

কোজিবাকভ বলেন, ক্যাভিয়ারের স্বাদটা লবণাক্ত ছিল, আর তাতে সামুদ্রিক গন্ধ পাওয়া যেত।

তবে ৪০ বছর পর ওই পারিবারিক রীতি এখন তাঁর কাছে শুধুই স্মৃতি। আকতাউ শহরের দোকানে এখন আর প্রাকৃতিক ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় না। অতিরিক্ত মাছ ধরা ও তাদের আবাসস্থল কমে যাওয়ার কারণে স্টারজন মাছ এখন বিপন্নপ্রায়। শিগগিরই হয়তো সাগরটাও হারিয়ে যাবে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শতাব্দীর শেষ নাগাদ কাস্পিয়ান সাগরের পৃষ্ঠভাগের উচ্চতা ১৮ মিটার পর্যন্ত কমতে পারে ও সাগরের ৩৪ শতাংশ পৃষ্ঠতল হারিয়ে যেতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যদি ৫ থেকে ১০ মিটার পানিও কমে যায়, তাহলে কাস্পিয়ান সিল ও স্টারজন মাছের আবাসস্থলসহ সেখানকার বাস্তুব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কোজিবাকভ বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক পরামর্শক কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, ‘এই সাগর যে ছোট হয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য গবেষণার দরকার নেই। খালি চোখেই এটা দেখা যায়।’

রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরের অবস্থান। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলবেষ্টিত জলাশয়। রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে চীন থেকে ইউরোপ যাওয়ার দ্রুততম পথ এবং তেল-গ্যাসের একটি বড় উৎস এটি

আদিলবেক কোজিবাকভ, বাস্তুতন্ত্রবিদ

অনেকে আশঙ্কা করছেন, কাস্পিয়ান সাগরের পরিণতি হয়তো পার্শ্ববর্তী আরাল সাগরের মতো হবে। কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের মাঝে আরাল সাগর। ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলার খেত সেচ দিতে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার করায় আরাল সাগর শুকাতে শুরু করে। এসব নদী থেকে আরাল সাগরে পানি আসত। শুরুতে আরাল সাগরের আয়তন যা ছিল, সে তুলনায় এখন আছে মাত্র ১০ শতাংশ। আরালের পানি কমে যাওয়ার কারণে স্থানীয় বাস্তুব্যবস্থা ও মানুষের ওপর খারাপ প্রভাব পড়েছে।

কাস্পিয়ান সাগরের সমস্যা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়নি।

কাস্পিয়ান সাগরের পানির ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই আসে রাশিয়ায় অবস্থিত ভলগা নদী থেকে। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘতম নদী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার পানি ব্যবস্থাপনার কারণে সাগরের পানি কমে যাচ্ছে।

আদিলবেক কোজিবাকভ বলেন, ‘বছরের পর বছর রাশিয়া ভলগা নদীতে অনেক বাঁধ দিয়ে ও পানি সংরক্ষণাগার তৈরি করেছে। কৃষি ও শিল্পকারখানার জন্য এর পানি ব্যবহার করছে। এতে এখন কাস্পিয়ান সাগরে অনেক কম পানি পৌঁছাচ্ছে।’

আদিলবেক আরও বলেন, ‘এক শ বছর আগে স্টারজন মাছ অনেক বছর বেঁচে থাকত, কেউ সেগুলো ধরত না। তখন এগুলো এত বড় হতো যে এখন শুধু পুরোনো ছবিতেই সেগুলো দেখা যায়। শিকারিদের দাপট আর তেল কোম্পানির দূষণের কারণে স্টারজন মাছ বিপন্ন হয়ে গেছে।’
রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরের অবস্থান
রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরের অবস্থানফাইল ছবি: এএফপি

কাজাখস্তানে সোভিয়েত আমলে আবিষ্কৃত তিনটি বড় তেলক্ষেত্র এখন বিদেশি কোম্পানিগুলো চালায়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরিবেশবিষয়ক আইনজীবী ভাদিম নি ‘সেভ দ্য কাস্পিয়ান সি’ নামে একটি প্রচার চালিয়ে নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, সরকার বিদেশি তেল ও গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তিগুলো করেছে, তা গোপন রাখা হয়েছে। ফলে সেগুলোর পরিবেশগত প্রভাব বোঝা কঠিন।

১৯৯০-এর দশকে কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পর দেশটিতে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেখে বড় বড় বিদেশি কোম্পানি ও তাদের আইনজীবীরা কাজাখ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের চেষ্টা করে। সরকারের সঙ্গে তারা এমনভাবে চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে, যেন তা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিগত আইনের অধীন পড়ে ও সব তথ্য গোপন রাখা যায়। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ হলে দেশের আদালতে নয়, আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মীমাংসা করতে হয়।

ভাদিম নি-এর মতে, এটা অন্যায় ও আরহুস কনভেনশনের মতো আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। আরহুস কনভেনশন অনুযায়ী, পরিবেশ-সংক্রান্ত তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।

ভাদিম নি আরও বলেন, ‘তেল কোম্পানিগুলো চায় না তাদের আয় কমে বা পরিবেশ নিয়ে দায়দায়িত্ব বেড়ে যাক। কোম্পানিগুলো প্রায়ই পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করে দেখাতে চায় যে তারা নিয়ম মেনে চলছে। তবে যেহেতু এসব গবেষণার সঙ্গে তাদের নিজেদের স্বার্থ জড়িত, তাই এর ফলাফল কতটা নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।’

আদালত নি-এর মামলা গ্রহণ করেননি। আদালত বলেছেন, এ ক্ষেত্রে মামলা করার কোনো ভিত্তি নেই। তবে নি বলেছেন, তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে গেলেও তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

ইতিমধ্যে কাস্পিয়ান সাগরকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আকতাউ শহরে কোজিবাকভ স্থানীয় প্রশাসন, বাসিন্দা ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক বার্তা দিচ্ছেন।

কোজিবাকভ বলেন, ‘আমরা নিচুতলার মানুষদের থেকে এ সচেতনতা শুরু করতে চাই, যেন সরকার বুঝতে পারে যে বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ ভীষণ উদ্বিগ্ন। শুধু বাস্তুতন্ত্রবিদরাই নন, আকতাউর সাধারণ বাসিন্দাদের যাঁরা এ শহরে বড় হয়েছেন, তাঁরাও তাঁদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।’

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.