নিম্নমানের নিরীক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে: আইসিএমএবি

নিম্নমানের নিরীক্ষা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করেছে, যার ফলে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)।

মঙ্গলবার (১৭ জুন) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটরিয়ামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইসিএমএবি’র প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ এফসিএমএ লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপুস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সেলিম এফসিএমএ, সাবেক প্রেসিডেন্ট মোঃ দেলোয়ার হোসেন এফসিএমএ, ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোঃ কাউসার আলম এফসিএমএ, সেক্রেটারি হাসনাইন তৌফিক আহমেদ এফসিএমএ, কাউন্সিল সদস্য মোঃ আখতারুজ্জামান এফসিএমএ এবং কাউন্সিল সদস্য মোঃ জাহাঙ্গীর আলম এফসিএমএ।

লিখিত বক্তব্যে মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত দেড় দেশকের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কারনে বাংলাদেশে নিরীক্ষা ইকোসিস্টেম সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে-যা দেশের বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক খাত (যেখানে আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যাংক সম্পদ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে), এবং অস্থির শেয়ারবাজারে প্রচলিত দূর্বল শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।

তিনি বলেন, নিম্নমানের নিরীক্ষা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করেছে, যার ফলে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (বাংলাদেশে ১ দশামিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ভিয়েতনামে তা ৩৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে খেলাপী ঋণ ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা যা মোট বিতরণকৃতঅণের প্রায় ২৫ শতাংশ। পর্যাপ্ত তদারকির অভাব, দুর্বল আইন প্রয়োগ, এবং সীমিত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, যেখানে তদারকির ব্যর্থতাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে, বৈশ্বিক সেরা অনুশীলনের উদাহরণ, (Global Best Practice) দাতা সংস্থাগুলোর (বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক) পরামর্শ এবং অন্যান্য অংশীজনের মতামত বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। সেই সময়ে, এই সংস্কার কার্যকর করার ক্ষেত্রে আইসিএমএবি কার্যকরী অংশীদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সংখ্যা মাত্র প্রায় ২ হাজার ৫ জন, যেখানে ভারতে রয়েছে ৩,৭৫,০০০ জন, পাকিস্তানে ১০ হাজার ৯৬ জন, শ্রীলঙ্কায় ৭ হাজার জন এবং নেপালে ৯হাজার ৫২ জন যা আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পেশাদার হিসেববিদদের ঘাটতির প্রমাণ দেয়। ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (FRC)-এ কাউন্সিল (FRC)-এ নিবন্ধিত ফার্মের সংখ্যা মাত্র ২০৯টি, এবং ICAB-এর প্রায় ৫০০ জন প্র্যাকটিসিং সদস্য রয়েছেন, যাদের ওপর নিবন্ধিত ৩ লাখ এরও বেশি কোম্পানির নিরীক্ষার দায়িত্ব রয়েছে (সক্রিয় কোম্পানির সংখ্যা কম হতে পারে)। এটি বাংলাদেশের নিরীক্ষা পরিবেশ এর বর্তমান বাস্তব চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

আইসিএমএবি’র প্রেসিডেন্ট বলেন, উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশে একাধিক পেশাদার সংস্থাকে স্ট্যাটুটরি বা বিধিবদ্ধ নিরীক্ষার অধিকার প্রদান করা হয়েছে যাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রোধ করা যায়। কানাডায় এমনকি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA), সার্টিফায়েড জেনারেল অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CGA) এবং সার্টিফাইড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CMA) এই তিনটি পেশাদার সংস্থাকে একত্র করে সিপিএ (CPA) গঠন করার উদাহরণও রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি সফল সমন্বয় ও সহযোগিতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে নির্দিষ্ট শর্তাবলীর আওতায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস (CA) ছাড়াও একাধিক পেশাদার সংস্থা স্ট্যাটুটরি বা বিধিবদ্ধ নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। CAB এর পাশাপাশি।CMA ছাড়া আর কোনো হিসাববিদ প্রতিষ্ঠান নেই।

তিনি বলেন, নিরীক্ষা জগতে একটি বাস্তবতা আজ সুস্পষ্ট দেশে বছরে প্রায় ৩ লাখ নিবন্ধিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং আরো অনেক বেশি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। মাত্র ৫০০ জন প্র্যাক্টিসিং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং ২০৯ টি ফার্ম দিয়ে তা কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা একেবারেই অবাস্তব। কারণ, এই ফার্মগুলো শুধু নিরীক্ষা নয়, বরং ট্যাক্স ও ভ্যাট পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবাও দিয়ে থাকে। এত অল্প সংখ্যক ফার্ম এর মাধ্যমে জাতীয় প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারা এক প্রকার অসম্ভব। উপরন্তু, নিরীক্ষা একটি বিশেষায়িত সেবা, যেখানে পরিমাণের চেয়ে গুণমানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মাহতাব উদ্দিন বলেন, দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূরীকরণের ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের Draft বাজেটে FRC কর্তৃক সংজ্ঞায়িত Professional Accountant (CA ও CMA) দ্বারা লিমিটেড কোম্পানি ব্যাতীত সকল প্রতিষ্ঠান (SME সহ) নিরীক্ষা করানোর বিধান অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু একটি স্বার্থন্বেষী মহলের প্ররোচনায় অর্থবিল হতে CMA দেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে এবং আর্থিক সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে CMA দেরকে সুযোগ দিয়ে সে বিধানটি পুনরায় বাজেটে অর্ন্তভুক্ত করার জোর দাবী জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধিরধারা বজায় রাখতে গেলে নিরীক্ষা Eco System-এ আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এই সংস্কারের কথা চিন্তা করেই FRC ACT-2015, CA এবং CMA দেরকে প্রফেশনাল হিসাববিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের দাবী, এই স্বীকৃতি অন্যান্য সব আইনে সন্নিবেশিত করা হোক, যেটা কোম্পানিজ অ্যাক্ট এর সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য FRC অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.