স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য দরকারি, অপরিহার্য ব্যয় মেটাতেই এই বাজেট। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য তৈরি হয়েছিল বাজেটটি। বাজেটের আকার ছিলো ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে ৫৩টি বাজেট।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা গেছে, গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাইরে এ বছর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে (রেকর্ড করা) আজ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠকে অনুমোদন শেষে তাতে সই করবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর অর্থ উপদেষ্টা বাজেট ডকুমেন্টস নিয়ে রামপুরার বিটিভি ভবনে যাবেন। সেখানেই রেকর্ড করা হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। যা বিকাল ৩টায় সম্প্রচার করা হবে।
প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে রাজস্ব বাজেটের আকার ৫ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম এবার। এবারই প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার কমছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকার আসন্ন জাতীয় বাজেট ১০টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে সাড়ে ছয় শতাংশ। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
আসন্ন বাজেটে উচ্চাভিলাষী কোনো লক্ষ্যমাত্রা থাকবে না। এবার উন্নয়ন বাজেট ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ও রাজস্ব বাজেট ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে।
রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির সমন্বয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাজেটে সংস্কার কমিশন ও টাস্কফোর্স রিপোর্টের সুপারিশগুলো প্রতিফলিত হবে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সহায়তা পেতে বাজেট ঘাটতি কমানো, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
রাজস্ব বাজেটের ৫৭ শতাংশ বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। শুধু ভাতা ও বেতন বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা চালু হতে পারে। এটি সরকারের খরচ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন- আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা করছে। রাজস্ব বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকবে। সরকার পর্যায়ক্রমে এর পরিমাণ কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে।
রাজস্ব চাপ কমাতে সরকার বিদেশি ঋণের ওপর বেশি ঝুঁকবে। বিশেষ করে, বাজেট সহায়তার জন্য। বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২০ থেকে ৩০ বছর সময় পাওয়া যায়। অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে সময় পাওয়া যায় পাঁচ বছর।
রাজস্ব আয় কম হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা সামাজিক সুরক্ষায় খরচ বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। তবুও, এই খাতগুলো সরকারের ১০ অগ্রাধিকারের মধ্যে আছে। বাজেটে কম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ভর্তুকিসহ মূল সামাজিক কর্মসূচিগুলো কিছুটা বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে।
সরকারের ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয় পাবে দুই লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট খরচের প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ খরচের সবচেয়ে বড় বরাদ্দ যাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে। এর আগে তালিকার শীর্ষে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগে এ বছর বরাদ্দ কমবে।
প্রতিরক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, বিদ্যুৎ এবং সামাজিক কল্যাণে বরাদ্দ সামান্য কমতে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জননিরাপত্তায় বরাদ্দ সামান্য বাড়তে পারে। কৃষি ও সড়ক পরিবহনে বরাদ্দ আগের মতো থাকার সম্ভাবনা আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন- বাজেটে মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চার দশমিক ২৫ শতাংশ ও সংশোধিত প্রাক্কলনের তুলনায় আট দশমিক আট শতাংশ বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটি মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তিন দশমিক ৯৫ শতাংশ ও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাত দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
রাজস্ব বাড়াতে সরকার কর সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে আছে ১৫ শতাংশ অভিন্ন ভ্যাট হার চালু করা ও কর রিটার্ন দাখিলের জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই ব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলও নেওয়া হচ্ছে।
বাজেটে প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে ভ্যাট নিবন্ধনের নিয়ম কঠোর করা। করের পরিধি বাড়ানোর অংশ হিসেবে বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আগে এই সীমা ছিল তিন কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যেও অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। এটি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি আরও নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি বিনিয়োগ ও এফডিআই সুবিন্যস্তকরণ, সম্পূর্ণ আর্থিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক ও দেশীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করার মতো কঠিন কাজও রয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পকে সহজতর করা, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এফডিআই আকর্ষণ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, কর পরিপালন ঘাটতি কমানো, ভ্যাটের হিসাব ব্যবস্থা সহজীকরণের ওপর জোর দেওয়া হবে। এছাড়াও, ভ্যাট আদায়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পূরক শুল্ক হারকে যৌক্তিক করতে সংশ্লিষ্ট আইনের কিছু বিধান সরলীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.