স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য দরকারি, অপরিহার্য ব্যয় মেটাতেই এই বাজেট। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য তৈরি হয়েছিল বাজেটটি। বাজেটের আকার ছিলো ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে ৫৩টি বাজেট।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
বাজেট বক্তৃতার শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় শহীদদের। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তিনি বলেন, ‘২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এর পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।’
গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির যাতাকলে পিষ্ট দেশের মানুষ। বিগত সময়ে প্রতিবছরই সরকার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এবারও বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত দুই বছরে প্রকৃত আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্যান্য দেশের ন্যায় ২০২২-২৪ অর্থবছর থেকে মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠে, যা সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম সর্বোচ্চ। তবে দেশে এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯ থেকে ১০ শতাংশে রয়েছে। তবে নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে টেনে ধরা হবে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার নেয় তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি।
এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সব চাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।
আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অন্যান্য উৎস থেকে। যেখানে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের মাঝে এসে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, আর ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক উৎস থেকে।
মোট বাজেটের মধ্যে পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি ব্যয়ের খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এডিপি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সংকোচনমূলক বাজেট।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যেও অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। এটি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি আরও নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি বিনিয়োগ ও এফডিআই সুবিন্যস্তকরণ, সম্পূর্ণ আর্থিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক ও দেশীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করার মতো কঠিন কাজও রয়েছে।
এর আগে সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন দেশের দায়িত্বে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হয়েছিল তখনকার অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বাজেট বক্তব্য (২০০৮-২০০৯ অর্থবছর)। আসন্ন অর্থবছরের বাজেট হবে দেশের ৫৪তম বাজেট। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ওই বাজেট পেশ হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ওই দিন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর, অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এরপর আরও দুবার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ, সেটি সবশেষ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকার। ১৩ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দিয়েছেন সদস্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এম সাইফুর রহমান। দুজনেই ১২টি বাজেট উত্থাপন করেছেন। তবে আবুল মাল আবদুল মুহিতই আওয়ামী লীগের হয়ে টানা ১০ বার বাজেট পেশ করেছেন। তিনি প্রথম বাজেট দেন ১৯৮২-৮৩ সালে, এরশাদের শাসনামলে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.