‘আমার নাতনিটা আজ বাড়ি আসবে বলছিলো। কিন্তু সে যে লাশ হয়ে আসবো তা তো বুঝি নাই। আমি এখন তার জন্য কবর খুঁড়ি’- বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নিজ এলাকায় ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ঢাকায় এসে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া পটুয়াখালীর কলেজছাত্রীর দাদা আব্দুস সোবহান।
ওই ছাত্রীর বাবার কবরের পাশেই তার জন্য আজ কবর খুঁড়েছেন তার দাদা নিজেই। তিনি বলছিলেন, গতকাল সকালেও নাতনির সাথে কথা হলো। ভাবছিলাম ছেলে গেছে, নাতনি তো আছে। সেও চলে গেলো”।
এই কলেজছাত্রীর বাবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। শনিবার ওই কলেজছাত্রীর আত্মহননের ঘণ্টাখানেক আগেই তাদের বাসায় গিয়ে কথা বলেছিলেন জুলাই ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তি।
‘মেয়েটি খুব কম কথা বলছিলো। হঠাৎ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, কাঁদল। বললো-আল্লাহ যা করে,সেটা নাকি ভালোর জন্যেই করে। আমার কি ভালো করসে বলতে পারেন? আমার সাথে খালি খারাপ ই হইসে!’- বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ওই কলেজছাত্রীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বাবার কবর জেয়ারত করে নানীর বাড়ি যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাই ওই ছাত্রীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা। তবে ওই ঘটনার পর গ্রামের লোকজনের নানা কথা, ফিসফাস কিংবা নানা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে মানসিকভাবে সে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো বলেই তাদের ধারণা।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলছেন, ধর্ষণ শুধু একটি শারীরিক আঘাত নয়, এটা বড় মানসিক আঘাত। মানুষ যখন বিশেষ মানসিক অবস্থায় পড়ে যায় তখন আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়।
‘এ ধরনের ক্ষেত্রে ভিকটিমের মানুষের প্রতি অবিশ্বাস ও ভয় তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা তৈরি হয়। অন্যরা তাকে বারবার প্রশ্ন করলে সেটি তাকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে’- বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ওই কলেজছাত্রীরা মামা মোঃ মাহবুব মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শনিবার রাতে ঢাকার শেখেরটেকের বাসায় ওই ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহননের পথ যখন বেছে নিয়েছিলো, তখন বাসায় আর কেউ ছিলো না। তার মা তখন তার আরেক বোনকে নিয়ে কাছেই একটি মাদ্রাসায় গিয়েছিলো। তাদের আরেকটি ছোট ভাইসহ এক রুমের ওই বাসাতেই তারা বসবাস করতেন।
ওই কলেজছাত্রী অবশ্য গ্রামে তার নানীর কাছেই থাকতেন। কয়েকদিন আগে জুলাই ফাউন্ডেশনের সহায়তা কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিলো। তার আত্মহননের কিছুক্ষণ আগেই জুলাই ফাউন্ডেশনের হয়ে ওই ছাত্রীর বাসায় গিয়ে দেড় ঘণ্টার মতো ছিলেন বলে সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তি (তার ভাই মাহবুবুর রহমান সৈকত জুলাই আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন)।
“যখন থেকে ঢাকায় এসেছে তখন থেকেই আমার যোগাযোগ। বারবার বলছিলো- আমার বাবা কেন চলে গেলো। আমরা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ওর সাথে যা ঘটেছে তা অনুধাবন করাও কষ্টের। দেখেই বিষণ্ণ লাগছিলো। শেষ দিকে খুবই শক্ত করে জড়ায়া ধরলো, কান্না করলো। আমরা বলেছি, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো ছিলো, এইচএসসিতেও ভালো করতে হবে। এমন অনেক কিছু বলে সহজ করার চেষ্টা করেছিলাম,” বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।
তিনি তার ফেসবুক পাতায় ওই কলেজছাত্রীর মৃত্যুর আগে তার সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে যে লেখা লিখেছেন সেখানে বলেছেন, “আমাকে সে কথা দিলো ঠিক করে পড়াশোনা করবে, কোনো দরকারে আমাকে কল দিবে! কিন্তু কি হয়ে গেলো!! কেন হলো জানেন? এ বাড়ি থেকে দু’কথা, ও বাড়ি থেকে দু’কথা, ফিসফিসানি, সুযোগ বুঝেই নোংরা তকমা- এগুলো বাচ্চাটি নিতে পারেনি! কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো তাকে এসব। তার মা এবং তার পরিবার এসব থেকে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো! তার মা আমাকে আজকে বলেছিলো, ওর ইন্টার পরীক্ষা শেষ হলে তারা সবাই মিলে অনেক দূরে চলে যাবে, যেখানে কেউ তাদের চিনবেনা, আঙুল তুলে কথা বলতে পারবেনা!”
এর আগে গত ১৮ মার্চ পটুয়াখালীর পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের নিজ বাড়ি থেকে নানা বাড়ি যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হন ওই কলেজছাত্রী। তার দাদা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “সেদিন বাবার কবর জেয়ারত করেছিলো আমার নাতনি। তারপর আমাদের বাড়ি আসার কথা। কিন্তু তার নানী ফোন দিয়ে বলছে যে তার খাবার নেই। এটা শুনে তখনই নানী বাড়ী রওনা দেয় সে। এরপর রাতে ও সকালে ফোন দিয়ে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে প্রশাসন থেকে খবর দিয়ে আমাকে নেয়া হয়। পরে হাসপাতালে গিয়ে নাতনিকে পাই। তার তখন আর কথা বলার শক্তি ছিলো না”।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, নানীর বাড়ি যাওয়ার পথেই আক্রান্ত হন ওই কলেজছাত্রী। ধর্ষকরা তার ভিডিও ধারণ করে মুখ বন্ধ রাখতে ভয় দেখায়। পরে বিশে মার্চ নিজেই থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন তিনি। মামলার পর মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাওয়ার পর পুলিশ ওই ঘটনায় মামলায় অভিযুক্ত দুজনকে আটক করে। এর মধ্যে একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।
শনিবার রাতে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, জুলাই শহীদ পটুয়াখালীর জসিম ভাইয়ের মেয়ে কিছুদিন আগে বাবার কবর জেয়ারত করতে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর সে নানা চিকিৎসা নিচ্ছিলো। তার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। ঘটনা জানার পর থেকে আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছিলাম। ডাক্তার নিয়োগ করে মেন্টাল কাউন্সেলিং করা হচ্ছিলো। তার মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করেছে। সোহরাওয়ার্দীতে আনার পর তাকে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
পরিবার বলছে জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর তার মা তার বোনকে নিয়ে মাদ্রাসায় যান। ওই সময়ই আত্মহননের পথ বেছে নেয় ওই কলেজছাত্রী। আজ ময়না তদন্তের পর তার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা মরদেহ নিয়ে পটুয়াখালীতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলছেন, ধর্ষণ একজন মানুষকে চরমভাবে মানসিক বিপর্যস্ত করে দেয়। এ ধরনের ঘটনায় অনেক সময় পরিবারও ট্রমার মধ্যে পড়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই ট্রমার সাথে ব্যক্তি ও পরিবার সবারই খাপ খাইয়ে নেয়া কঠিন। তাই সবার উচিত তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া। অনেক সময় পরিবারেরও কাউন্সেলিং দরকার হয়। অনেক সময় ভিকটিমকে উল্টো দোষারোপ করা হয়। এজন্য পরিবার সমাজে সবার দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি। ভিকটিমকে আশ্বস্ত করা, তার পাশে দাঁড়ানো দরকার।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.