আইএমএফর সংস্কার দাবি: মুক্ত বাজার অর্থনীতি নাকি জনগণের দুর্ভোগ?

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের শুরুর দিকে চুক্তিবদ্ধ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের আওতায় প্রথম কিস্তি ৪৭৬.২ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয় ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ, দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮১ মিলিয়ন ডলার ডিসেম্বরে এবং তৃতীয় কিস্তি ১.১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয় ২০২৪ সালের জুনে। পরবর্তী চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি বাবদ ১.৩ বিলিয়ন ডলারের কিস্তি ছাড়ে দ্বিধা প্রকাশ করেছে আইএমএফ| সম্প্রতি আইএমএফ-এর মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাগিওর্জিউ তাদের দুই সপ্তাহের ঢাকা মিশন শেষে কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে চূড়ান্ত কোন সিধান্ত না জানিয়েই ঢাকা ত্যাগ করেছেন । কারণ তারা আরও কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগছে, এই ঋণ কি আমাদের জন্য এতটাই জরুরি, যা পেতে গিয়ে জনগণের কাঁধে চরম সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে?

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আইএমএফ-এর পরামর্শে বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে- গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন পণ্যে ও সেবায় কর বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত। এসব পদক্ষেপে আর্থিক কাঠামো হয়তো আইএমএফ-এর দৃষ্টিকোণে সঠিক, কিন্তু বাস্তবতা হলো এর চরম মূল্য দিচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ। আমরা ইতোমধ্যে কয়েক বছর ধরে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহারে ভুগছি, আর এখন নতুন করে আরও চরম সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ আসছে।

আইএমএফ এখন যে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে বলছে, তার মধ্যে রয়েছে-১. সম্পূর্ণ মুক্ত মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা, ২. কর সংস্কার- প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাতে কর ছাড়, ৩. ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা ।

১. বাংলাদেশে সম্পূর্ণ উমুক্ত মুদ্রা বিনিময় হার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে-

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রায়শই একটি সম্পূর্ণ বাজারনির্ভর (মুক্ত ভাসমান) বিনিময় হার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছতা ও অর্থনৈতিক দক্ষতার উপায় হিসেবে প্রচার করে। তবে এই ধরনের একটি ব্যবস্থা সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে একটি পরিপক্ব, স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের উপস্থিতি প্রয়োজন যা এখনো বাংলাদেশের জন্য একটি চলমান প্রক্রিয়া।

যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই এমন একটি পদ্ধতি চালু করা হলে তা দেশের জন্য গুরুতর অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।কারণ:

১.১ মধ্যস্থতাকারীদের প্রভাব ও বাজারে কারসাজি

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অনেক মধ্যস্থতাকারী যেমন বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান, ডিলার ও এফএক্স ব্রোকার উচ্চ বিনিময় হারে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।২০২২ সালের এপ্রিলে ডলার রেট ছিল ৮৬ টাকা যা ২০২৫ সালের এপ্রিলে ১২২ টাকা ,গত তিন বছরে বেড়েছে ৩৬ টাকা, এর পিছনে অবশ্যই নানান পক্ষের কারসাজি রয়েছে| পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে:

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানরা ইন্টারব্যাংক মার্কেটে কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বিনিময় হার বাড়িয়েছে, যাতে তারা স্বল্পমেয়াদে লাভবান হতে পারে।

ডলার লেনদেন করে কিছুকিছু ব্যাংক ৩০০% থেকে ৪০০% পর্য়ন্ত মুনাফা বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী তদারকি ছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ উমুক্ত মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থা সহজেই জল্পনা-কল্পনার খেলায় পরিণত হতে পারে, যেখানে বাস্তব অর্থনৈতিক চিত্রের সঙ্গে বিনিময় হারের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

১.২ বাজারের গভীরতার অভাব ও তদারকির ঘাটতি

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার এখনো অতটা গভীর নয়, বাজারে অংশগ্রহণকারী ও আর্থিক যন্ত্রের সংখ্যাও সীমিত।এই পরিস্থিতিতে অল্প কিছু বড় অংশগ্রহণকারীই পুরো বাজারের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, বিশেষত যখন তারল্য কম থাকে।সুশৃঙ্খল ও বাস্তবসম্মত নজরদারির অভাবে বিভিন্ন কল্পনা প্রসূত আতক্ষ ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে টাকার মান বড়সর আকারে কমিয়ে দিতে পারে,যা ম্যাক্রো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করবে।

১.৩ আমদানি নির্ভর মূল্যস্ফীতি ও ব্যয়বৃদ্ধির ঝুঁকি

টাকার মান দ্রুত পতন হলে আমদানিকৃত জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধ এবং কাঁচামালের দাম সরাসরি বেড়ে যাবে| ফলে, মুদ্রাস্ফীতি আরও ত্বরান্বিত হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং স্বল্প ও মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠী আরও চাপে পড়বে, যারা ইতোমধ্যে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। সর্বোপরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে|

এই বাস্তবতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির জন্য সম্পূর্ণ উমুক্ত ভাসমান বিনিময় হার কেবল অর্থনৈতিক ঝুঁকিই নয়, সামাজিক বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে, যদি না আগে থেকে সুনির্দিষ্ট কাঠামো, দক্ষ নজরদারি ও স্বচ্ছ নীতিমালা নিশ্চিত করা হয়।

২. বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর কর ছাড় কমানো কেন জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে

আইএমএফ-এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বাকি কিস্তি পাওয়ার শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ধাপে ধাপে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর কর ছাড় কমাতে যার মধ্যে অনেক প্রয়োজনীয় এবং উন্নয়ন সহায়ক ক্ষেত্রও রয়েছে। যদিও এর উদ্দেশ্য রাজস্ব আয় বাড়ানো ও কর কাঠামোকে বিস্তৃত করা, তবে এর তাৎক্ষণিক এবং অসম প্রভাব সাধারণ জনগণের ওপর মারাত্মকভাবে পড়তে পারে। যেমন:

২.১ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি

বাংলাদেশে বর্তমানে যে কর ছাড়গুলো বিদ্যমান, তার বেশিরভাগই চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আটা, ঔষধ ও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসামগ্রী ও শিক্ষা-সেবা, পাবলিক পরিবহন ও কিছু ইউটিলিটি পরিষেবা|

এই কর ছাড় তুলে নেওয়া হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সরাসরি বেড়ে যাবে, ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে, যারা ইতোমধ্যেই তাদের উপার্জনের বড় একটি অংশ এসব পণ্যের পেছনে ব্যয় করে থাকেন।

২.২ একটি দুর্বল অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে

বাংলাদেশ বর্তমানে দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে। কর ছাড় একেবারে তুলে দিলে এতে খরচ-চালিত মুদ্রাস্ফীতি (cost-push inflation) বাড়বে, যার ফলে সরবরাহ চেইনের প্রতিটি স্তরে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং খুচরা বাজার ও পরিষেবা খাতে চাহিদার সংকোচন হবে|

এমন পরিস্থিতিতে সামান্য কর পরিবর্তনও বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে|

২.৩ গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর ছাড় অনেকটা পরোক্ষ সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মতো কাজ করে। এই ছাড় তুলে দিলে তা বিপরীতমুখী (regressive) প্রভাব ফেলবে| কারণ,ধনী ও গরিব সবাই পণ্যের ওপর একই হারে কর দেয় কিন্তু এর ভার গরিবদের ওপর বেশি পড়ে| পরোক্ষ কর তুলনামূলকভাবে কম আয়ের মানুষদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে|

যদি কোনো কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বা সরাসরি ভর্তুকি না থাকে, তবে এই ছাড় তুলে দিলে দারিদ্র্য আরও বাড়বে এবং সামাজিক বৈষম্য তীব্র হবে যা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের চেতনার পরিপন্থী।

২.৪ জনঅসন্তোষ ও আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি

কর বৃদ্ধিজনিত মূল্যবৃদ্ধি মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে বিশেষ করে যখন তা যথাযথ প্রস্তুতি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া আইএমএফের পরামর্শে বাস্তবায়ন করা হয়। এর ফলে,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে,সরকারি নীতির ওপর জনগণের আস্থা হারাতে পারে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত গঠাতে পারে|সর্বোপরি অর্ন্তবর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে|

২.৫ কৌশলগত খাত ও প্রবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধকতা

বর্তমানে অনেক কর ছাড় কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন খাতগুলোকে সহায়তা করার জন্য দেওয়া হয়েছে, যেমন:আইসিটি ও ডিজিটাল সেবা,কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ,নবায়নযোগ্য জ্বালানি,ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প|

এই ছাড় হঠাৎ তুলে দিলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং এসব খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে যা দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে|

লেখক- মোঃ আল-আমিন ভূঞাঁ

রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য কর সংস্কার অবশ্যই জরুরি, তবে সেটি পর্যায়ক্রমে লক্ষ্যভিত্তিক এবং সামাজিকভাবে সংবেদনশীল হওয়া উচিত। যদি কর ছাড় তুলে নেওয়া হয়, তাহলে অবশ্যই সেই সঙ্গে টার্গেটেড ভর্তুকি, বা সামাজিক নিরাপত্তা বলয় শক্তিশালী করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যথায়, এর প্রভাব লাখো মানুষের জীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনবে। বাংলাদেশের প্রয়োজন এমন এক করনীতি, যা রাজস্ব বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জনগণের জীবনমান ও ভোগ-আচরণকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।

এই পদক্ষেপগুলোকে বাজার-উন্মুক্তিকরণ বলা হলেও বাস্তবে এগুলো মানে হলো জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং বৈষম্য আরও প্রকট হওয়া যা নিঃসন্দেহে একটি জনবিরোধী ব্যবস্থাপনা।

৩. ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা জরুরি
আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন ছাড়াও আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরনে ব্যাংক খাতের সংস্কার অত্যাবশ্যক।রাজনৈতিক ও প্রভাবশালি মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপে এই খাতের ভীত নড়বড়ে ।বর্তমান ৩১ মার্চ ২০২৫ তারিখের হিসাব অনুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরনকৃত মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ নন পারফরমিং(NPL)যা টাকার অংকে ৩.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। প্রকৃত সংখ্যাটা আরো বেশি। দেশের বিগত সরকারের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক শিল্পগোষ্টির কাছে মোট বিতরনকৃত ঋণের পরিমান ১৫ শতাংশ।ধারনা করা হচ্ছে খুব শীগ্রই এই লোনগুলো সম্পূন বেড হয়ে যাবে যার ফলে নন পারফরম্যান্স লোনের পরিমান আরো ৩-৪% বেড়ে যাবে এবং নন পারফরমিং লোনের পরিমান দাড়াবে প্রায় ২৫% শতাংশে ।অর্থাৎ ১০০ টাকা বিতরনকৃত লোনের ২৫ টাকা না পাওয়ার আশংক্ষা তৈরি হয়েছে । অথাৎ রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের বলয় থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত রাখতে যোগপোযোগি সংস্কার ও যথাযত পদক্ষেপ সময়ের দাবি|

কেন এই ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার
২০২২ বা ২০২৩ সালের শুরুর অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে, যার পেছনে রয়েছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থিতিশীলতা, রপ্তানি খাতের স্থিতিশীল পারফরম্যান্স এবং মানিলন্ডারিং ও অর্থপাচার রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ।

ম্যাক্রো অর্থনীতির সূচকগুলো এখন অনেকটাই স্থিতিশীল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সামাজিকভাবে কষ্টদায়ক শর্তে ঋণ নেওয়া শুধু অপ্রয়োজনীয় নয় বরং অকার্যকরও হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: সতর্ক হওয়ার সময়
বিশ্বের অনেক দেশই আইএমএফ-এর কঠোর শর্তে ঋণ গ্রহণের ফলে ভোগান্তির মুখে পড়েছে:

ঘানা (২০২৩): ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের শর্তে কর ও ইউটিলিটি খাতে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হয়, যা বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনে।

পাকিস্তান (২০২২-২০২৪): ভর্তুকি প্রত্যাহার ও কর বৃদ্ধির ফলে চরম মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।

শ্রীলঙ্কা (২০২২): আইএমএফ শর্তে সংস্কার বাস্তবায়নের ফলে সামাজিক সেবা ভেঙে পড়ে, আর জনগণ চরম কষ্টে পড়ে।

এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক কাঠামোর কথা ভাবলেও মানবিক দিকটি প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা আলাদা, তাই সবাইকে এক ছাঁচে ফেলা উচিত নয়।

প্রয়োজন বাস্তববাদী ও জনমুখী নীতির

আমরা চাইলে জনদূর্ভোগ সৃষ্টিকারি কঠিন শর্তের আ্ইএমএফের লোনের পরিবর্তে বিকল্প পন্থায় সংকট মোকাবেলা করতে পারি| যেমন:

আয়কর ও রাজস্ব ব্যবস্থায় ডিজিটাল রূপান্তর এনে রাজস্ব আয় বাড়ানো, করনেট বৃদ্ধি করা ও ফাঁকি বন্ধ করা।

রপ্তানিতে বৈচিত্র আনা ও আরো বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহে উৎসাহিত করা এবং এই ধারা অব্যাহত রাখা।

বিকল্প দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক আর্থিক সহযোগিতা খুঁজে বের করা, যা আমাদের আর্থিক সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে সহায়তা করবে।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে চুরি যাওয়া সম্পদ জব্দ ও ফিরিয়ে আনা

উপসংহার
এই মুহূর্তে আমাদের ভাবতে হবে এই ঋণ দেশের মানুষের উপকারে আসছে, নাকি বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? অর্থনৈতিক সংস্কার অবশ্যই দরকার কিন্তু তা হতে হবে সহানুভূতিশীল ও বাস্তবভিত্তিক, শুধু আন্তর্জাতিক ঋণদান কারী সংস্থার চাপে নয়।

সরকারের উচিত অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, বিশেষ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যা তাদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আমি একজন নাগরিক হিসেবে বিশ্বাস করি, আমরা নিজেরাই একটি টেকসই ও মানবিক অর্থনৈতিক পথ তৈরি করতে পারি যেটি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর এবং দেশের মানুষের উপকারে আসবে।

অতএব, আজকের বাস্তবতায় প্রয়োজন নতজানু নীতির পরিবর্তে এমন একটি নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করা হবে দেশের নিজস্ব বাস্তবতা, জনস্বার্থ এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিবেচনায় রেখে। ঋণের বিপরীতে আমাদের কণ্ঠে থাকা উচিত যুক্তির ভাষা, মাথায় থাকা উচিত আত্মমর্যাদা বোধ।

মোঃ আল-আমিন ভূঞাঁ
কর্পোরেট ফাইন্যান্স এবং অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.